এত দর্শক জি বাংলা দেখছে কেন? বিশ্বজিৎ চৌধুরী

download (1)ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি বাংলা আমাদের দর্শকদের রুচি নষ্ট করছে, এই চ্যানেলের ধারাবাহিক নাটকগুলোতে এত রকম পারিবারিক কূটকচালি দেখানো হয় যে তা আমাদের সমাজজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে—এসব অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ‘পাখি পোশাক’-এর আবদার না মেটানোয় এ দেশের এক বা একাধিক কিশোরীর আত্মহত্যার কথা তো সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছে। জি বাংলার একটি সিরিয়ালের চরিত্র এই পোশাকটি পরেছিল, যা দেখে প্রলুব্ধ হয়েছিল আমাদের গ্রাম্য কিশোরী। সুতরাং এই মৃত্যুর জন্যও কিছুটা দায়ী করা গেল জি বাংলাকে। মোটকথা এই টিভি চ্যানেল (স্টার জলসা বা অন্য দু-একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলও কিছুটা) যে বৃহত্তর অর্থে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি এবং তাৎক্ষণিক বিবেচনায় আমাদের বিনোদন মাধ্যমগুলোর জন্য যে রীতিমতো হুমকি হয়ে উঠেছে, এ বিষয়ে একমত অনেকেই।
নানা মহল থেকে তাই দাবি উঠেছে, এই চ্যানেলটির প্রচার বন্ধ করা হোক। কিন্তু সাধারণ দর্শককে কিছুতেই বিরত রাখা যাচ্ছে না। রিমোটটি তো তাঁদের হাতে, তাঁরা বারবার সেখানেই যাচ্ছেন। ঘরে ঘরে তো বটেই, রেলস্টেশন বা বেসরকারি হাসপাতালের অপেক্ষাকক্ষের মতো জনসমাগমের স্থানগুলোতেও অবিরাম চলছে জি বাংলা। এর অনিবার্য ফল যেটা, বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও প্রচারিত হচ্ছে জি বাংলায়। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন হয়তো তুলতে চাইবেন কেউ, কিন্তু শেষ বিচারে টিভি রেটিং পয়েন্টই (টিআরপি) তো প্রধান বিবেচ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে। পণ্যের প্রচার যেখানে বেশি, সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার মতো ব্যবসায়িক নির্বুদ্ধিতার পরিচয় তাঁরা দেবেনই বা কেন?
জি বাংলার সম্প্রচার বন্ধ করার দাবি যৌক্তিক কি না, সে প্রশ্নে আপাতত না গিয়ে দেশের প্রায় ৩০টিরও বেশি টিভি চ্যানেলের একটিও কেন জনপ্রিয়তার বিচারে তাকে ছাপিয়ে যেতে পারল না, সে প্রশ্ন কি তুলতে পারি? জি বাংলা কেন দর্শকপ্রিয় তার কোনো জরিপ কি এ দেশে করা হয়েছে? টিভিতে দর্শক আসলে কী দেখতে চায়, তারও কি কোনো জরিপ কোনো টিভি চ্যানেল বা গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান কখনো করেছে? বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে খণ্ডনাটক, ধারাবাহিক নাটক, রিয়েলিটি শো বা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে, যা গুণে-মানে জি বাংলার নিচে নয়। কিন্তু তবু কেন আজ জি বাংলার এই রমরমা?
এ দেশে বেশ কটি বিশেষায়িত সংবাদ চ্যানেল আছে। তারা স্বাভাবিকভাবেই সংবাদ ও সংবাদসংক্রান্ত নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু একটিও নির্ভেজাল বিনোদননির্ভর চ্যানেল কি আছে, যেখানে শুধুই দর্শক মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা রয়েছে? একটি ছোট পরিবারে যদি চার থেকে পাঁচজন সদস্য থাকে, তার মধ্যে কজন দেশের দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আগ্রহী, আর কজন শুধুই বিনোদনের আশায় টিভির সামনে বসেন—তার হিসাবটা বোধ হয় কখনো করা হয়নি। আমাদের যেকোনো টিভি চ্যানেলে বেশি বিজ্ঞাপন প্রচারের প্রবণতার কথা বাদ দিয়েও দিনের সংবাদ, বিটিভির সংবাদ সম্প্রচার, সংবাদ শিরোনাম, সংবাদ বিশ্লেষণ, টক শো প্রচারের পর আর কতটা সময় অবশিষ্ট থাকে গান, নাটক বা অন্য কোনো বিনোদননির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের? দর্শকই বা এত তালগোলের মধ্যে কী করে নিশ্চিত হবেন ঠিক কোন সময়ে কোন অনুষ্ঠানটি দেখা যাবে? তার পরও কোনো একটি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে তিনি যদি মনোনিবেশ করেন এবং মজে যান সেই অনুষ্ঠানে, এর মধ্যে হঠাৎ করে স্ক্রলে যদি তিনি দেখতে পান মেঘনায় লঞ্চডুবিতে মানুষের মৃত্যুসংবাদ কিংবা রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যার রোমহর্ষক খবর, তাঁর পক্ষে অনুষ্ঠানের আনন্দে ডুবে থাকা কি আদৌ সম্ভব? দর্শককে এ রকম মনস্তাত্ত্বিক চাপের মধ্যে ফেলে যে আর যা-ই হোক অনুষ্ঠানকে উপভোগ্য করা যায় না।
ভারতে কিছুদিন আগে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল। এনডিটিভি, আজতক, জি নিউজ প্রভৃতি ভারতীয় নিউজ চ্যানেল নানাভাবে এই মহাযজ্ঞের সংবাদ প্রচার ও সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরেছে কিছুক্ষণ পর পর। কিন্তু একই দেশের চ্যানেল সনি, জি সিনেমা বা স্টার প্লাসের পর্দায় এতটুকু উত্তাপ ছিল না সেই নির্বাচনী ডামাডোলের, তাদের দর্শকেরা শাহরুখ-সালমান বা কারিনা-ক্যাটরিনাতেই মজে ছিল ওই সময়। দুনিয়ার কোথাও কোনো চ্যানেলই সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে না, করলে বিবিসি, সিএনএন বা আল–জাজিরার সঙ্গে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, এইচবিও, এমটিভির মধ্যে পার্থক্য থাকত না। টার্গেট দর্শক নিয়ে এই শ্রেণিভেদ করতে না পারাই এ দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলে মনে হয়। নিজেদের টার্গেট অডিয়েন্স নির্ধারণ করা দরকার আগে। নাহলে একমুঠো বিজ্ঞাপন, আধমুঠো সংবাদ আর এক চিমটে নাটক-সিনেমা গেলানো যাবে না সব শ্রেণির দর্শককে। জি বাংলার সম্প্রচার বন্ধ করা যে এর নিদান নয়, এ দেশীয় সিনেমাকে প্রটেকশনের নামে ৪৩ বছর বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভারতীয় ছবি চালানো বন্ধ রেখে সেই অভিজ্ঞতা তো হয়েছে আমাদের।
সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান (ধারাবাহিক নাটক, গান, ম্যাগাজিন, রিয়েলিটি শো ইত্যাদি) চালানোর মতো চ্যানেল আমাদের একটিও নেই। এ রকম চ্যানেলই হতে পারত জি বাংলার প্রকৃত প্রতিপক্ষ। জি বাংলার ধারাবাহিক নাটকগুলো দর্শক গোগ্রাসে গিলছে বাধ্য হয়ে। তাদের পারিবারিক ঘটনা বা আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের মিল নেই। এই দর্শকই যদি আমাদের পরিচিত জীবনের রূপায়ণ দেখতে পেতেন এসব নাটকে, তাঁদের আগ্রহ-কৌতূহল কোথায় গিয়ে পৌঁছাত?
এ দেশের টেলিভিশনে অসাধারণ কিছু সৃষ্টি আমরা দেখেছি একসময়। সকাল সন্ধ্যা, এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, রূপনগর, বহুব্রীহি, ৫১বর্তী, বন্ধন, রঙের মানুষ প্রভৃতি ধারাবাহিক নাটক দেখার জন্য বয়সনির্বিশেষে পরিবারের সদস্যরা অধীর আগ্রহে জড়ো হয়েছে টিভির সামনে। ‘চতুরঙ্গ’, ‘যদি কিছু মনে না করেন’, ‘অন্তরালে’, ‘প্রচ্ছদ’, ‘ইত্যাদি’র মতো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানও তো প্রাণভরে উপভোগ করেছে এ দেশের দর্শক। সবচেয়ে সেরা কাজ সম্ভবত হয়েছে এক পর্বের নাটকে। এত এত ভালো নাটক নির্মিত হয়েছে যে এক নিঃশ্বাসে সব নাম উল্লেখ করা অসম্ভব। তাহলে আজ কেন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি আমরা? কারণ, আমাদের টিভি চ্যানেল সংখ্যায় যত বেড়েছে, তত বেড়েছে বিশৃঙ্খলা।
আমাদের ধারণা, ভালো নাট্যকার-নির্মাতা বা অনুষ্ঠান-পরিকল্পকের অভাব নেই, বিচ্ছিন্নভাবে ভালো অনুষ্ঠান
কিছু হচ্ছে না তা-ও নয়, কিন্তু বিভ্রান্ত দর্শক জানেন না কোথায় কখন কী হচ্ছে। ফলে তাঁদের অনিবার্য গন্তব্য জি বাংলা। এই চ্যানেলটিতে চোখ রাখলেই একের পর এক গান-নাচ-নাটক-কৌতুক দেখার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে। যত দিন আমাদের চ্যানেলগুলো নিজেদের চরিত্র নির্ধারণ করবে না, তত দিন এ রকম হতে বাধ্য। মোদ্দা কথা, জি বাংলার এ দেশের দর্শকেরা এই বার্তাটিই তো দিচ্ছে, আমরা অন্তত কয়েকটি সম্পূর্ণ বিনোদননির্ভর চ্যানেল চাই, কর্মব্যস্ত দিনের শেষে নির্ভার হয়ে বসে যেখানে সংবাদ, সংবাদ-বিশ্লেষণ, সংবাদ শিরোনাম বা টক শোর মতো যাবতীয় কঠিন বাস্তবতা থেকে মুক্ত হয়ে গানে-গল্পে মজে থাকার মতো উপকরণের অভাব হবে না।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com


 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend