স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পরবর্তী ঘটনাপঞ্জি এইচ.টি. ইমাম

download (1)জনযুদ্ধ বা People’s War বলতে আমরা যা বুঝি সেই সংজ্ঞাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার অর্থে একটি অনন্য জনযুদ্ধ ছিল। সারা বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অধিকার বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের এক ঐতিহাসিক ত্যাগের সংগ্রাম। এই জনযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর সুদূরপ্রসারী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করে কাঙ্খিত স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছাত্রাবস্থা থেকেই গণমানুষের দাবি আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসকদের এ জনপদের মানুষের (পূর্ববঙ্গে) ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার যে অপকৌশল চলছিল, বঙ্গবন্ধু তা যথার্থ উপলব্ধি করতে পেরে সমগ্র জাতিকে নিয়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। মহীরুহের মত হয়ে উঠেন এ জনপদের নিপীড়িত, নিঃশোষিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। 

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সারা পৃথিবীর মানুষের নিকট দিবালোকের মতো স্পষ্ট হলেও আজও পাকিস্তানপ্রেমী কতিপয় ব্যক্তি ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। ‘স্বাধীনতা’ অর্জনকে রুখতে না পেরে প্রথমেই তারা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চালায়। চেষ্টা করে বাংলাদেশের ইতিহাসকে পাল্টে দিতে। স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করার এই অপচেষ্টা অবশ্য তাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যাদের ভাবাদর্শে এই অপশক্তি অনুপ্রাণিত, তাদের দুজন যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই ১৯৭২-৭৩ সনেই Provisional Constitutional Order 1972 ও Bangladesh Collaborators (Special Tribunal) Order, 1972 কে চ্যালেঞ্জ করে প্রথমে হাইকোর্ট ও পরে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। মহামান্য হাইকোর্ট এবং বিচারপতি এমএ সায়েমের নেতৃত্বে মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী উক্ত সদস্যদ্বয়ের আবেদনের কোন ভিত্তি বা যৌক্তিকতা না থাকায় তা খারিজ করে দেন (একেএম ফজলুল হক ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র)।

সামরিক অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারী মেজর জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় উক্ত অপশক্তি বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার সর্বাত্মক প্রয়াস চালায়। এত কিছুর পরও তাঁর শাসন কালীন সময়ে ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মফিজুল্লাহ কবীরকে চেয়ারম্যান করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস প্রণয়নের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। দলিল ও তথ্য প্রামাণ্য করণের জন্য ০৯ সদস্য বিশিষ্ট উক্ত কমিটিতে অন্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন : জনাব হাসান হাফিজুর রহমান, সদস্য সচিব, ড. সালাহউদ্দীন আহমদ, প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, ঢা.বি., ড. আনিসুজ্জামান, প্রফেসর, বাংলা বিভাগ, ঢা.বি., ড. এনামুল হক, পরিচালক, জাতীয় জাদুঘর, ড. কে.এম. মহসীন, সহযোগী প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, ঢা.বি., এবং ড. শামসুল হুদা হারুন, সহযোগী প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢা.বি. প্রমুখ বিশিষ্ট কবি, শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ। উক্ত কমিটি কর্তৃক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে ইতিহাস প্রণয়ন করা হয় (যা জিয়াউর রহমানের সময়ই প্রকাশিত হয়) সেখানেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তি সংগ্রাম, মুজিবনগর সরকার সম্পর্কিত সকল তথ্যাবলী, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় উত্তরণের বিষয়ে যথার্থ প্রমাণাদি প্রকাশিত হয়।

জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় তাঁর অনুসারীরা বা তিনি নিজে কখনও তাকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি না করলেও, তাঁর মৃত্যুর পর স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানিদের অনুগত এদেশীয় কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করে এদেশের বিজয়গাঁথাকে কলঙ্কিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম অতি শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করতেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, ১৯৯১ সালে প্রকাশিত জিয়াউর রহমানের “একটি জাতির জন্ম” শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বাঙালি জাতির জন্য অনুপ্রেরণামূলক বলে অভিহিত করে উল্লেখ করেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘোষণা তাদের কাছে গ্রিন সিগনাল বলে মনে হয়েছিল। জিয়ার বিবেককে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিসংগ্রামের পথে অনুপ্রাণিত করতে পারলেও তার দোসরদেরকে ভ্রষ্ট পথ হতে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে নাই। তাই তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী হয়ে বাঙালী নিধনে মরিয়া হয়ে উঠে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচনা ও মুদ্রণের যে প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তা ইতিহাস রচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও এই প্রকল্প স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত দলিল ও তথ্যসমূহ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যুক্তিসঙ্গত কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল ও তথ্য প্রকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই প্রকল্পে স্বাধীনতা যুদ্ধের অতি গুরুত্বপূর্ণ পটভূমির বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের পৃষ্ঠা ৪ ও ৫-এ “বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র” শীর্ষক স্বাধীনতার সনদ সন্নিবেশিত রয়েছে। এই সনদ তৈরির পেছনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে যা তত্কালে সারা পৃথিবীর মানুষ অবগত হয়েছিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি ও মার্চ মাসে সমগ্র পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গে এককভাবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীগণ জয়লাভ করেছিল। নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে পাকিস্তানি সামরিক চক্র পূর্ববঙ্গের (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের) নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের লেলিয়ে দেয়। এতে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। প্রায় এক কোটি বাঙালি সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়।

আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএ-গণ সীমান্ত অতিক্রম করে কৌশলগত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। মার্চের ৩০ তারিখে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিল্লিতে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও সাক্ষাত্ করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী এমএনএ এবং এমপিএদের নিয়ে একটি গোপন স্থানে অধিবেশন আহ্বান করেন। এঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায় তাঁদের ওই অধিবেশনের আইনগত ভিত্তি ছিল। এঁরাই গণপরিষদ গঠন করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। অধিবেশনে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যও নিযুক্ত করা হয়। এভাবে ১০ এপ্রিল সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বিশ্ববাসীকে অবহিত করে ঘোষণা প্রদান করেন। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শত শত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং উপস্থিত জনগণের সামনে মন্ত্রী হিসেবে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন। সেদিনের সেই ঘোষণাপত্রই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুদ্রিত রয়েছে। উল্লেখ্য, এই ঘোষণাপত্র ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশে সংবিধানের মূল ভিত্তি। ঘোষণাপত্রটি ছিল নিম্নরূপ :

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

(১০ এপ্রিল, ১৯৭১)

যেহেতু ১৯৭০ সালের ০৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত একটি শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল

এবং

যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত করেছিলেন

এবং

যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ১৯৭১ সালের ০৩ মার্চ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন

এবং

যেহেতু আহূত এ পরিষদ স্বেচ্ছাচার ও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়

এবং

যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের পরিবর্তে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে

এবং

যেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান

এবং

যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনাকালে বাংলাদেশের অসামরিক ও নিরস্ত্র জনসাধারণের বিরুদ্ধে অগুনতি গণহত্যা ও নজিরবিহীন নির্যাতন চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে

এবং

যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একত্র হয়ে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে ও নিজেদের সরকার গঠন করতে সুযোগ করে দিয়েছে

এবং

যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের দ্বারা বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের উপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে

সেহেতু

সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছে, সে মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি

এবং

এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন

এবং

রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হবেন,

রাষ্ট্রপ্রধানই ক্ষমা প্রদর্শনসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন,

তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রয়োজনবোধে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য নিয়োগ করতে পারবেন,

রাষ্ট্রপ্রধানের কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের এবং গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবির ক্ষমতা থাকবে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্যে আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।

বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি, যে কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন।

আমরা আরও ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হয়েছে তা আমরা যথাযথভাবে পালন করব।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্যে আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ক্ষমতা দিলাম এবং রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলাম।

উপর্যুক্ত স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তার ভিত্তি ছিল ঢাকায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু ওই তারিখের মধ্যরাতে অর্থাত্ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচারের জন্য চট্টগ্রামে প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা। বার্তাটি ছিল নিম্নরূপ:

This may be my last message, from today Bangladesh is indepentent. I call open the people of Bangladesh whereever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. (এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।)

স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তার ভিত্তিতে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অর্পিত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল “আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ ১৯৭১ (Laws Continuance Enforcement Order, 1971) জারি করেছিলেন। এই আদেশ ছিল নিম্নরূপ :

“আমি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই মর্মে আদেশ প্রদান করছি যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন ও বিধিবিধান কার্যকর ছিল সে সমস্তই প্রয়োজনীয় অবস্থাগত পরিবর্তনসহ পূর্বোক্ত ঘোষণা সাপেক্ষে বলবত্ থাকবে এবং সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, বেসামরিক-সামরিক, বিচার বিভাগীয়, কূটনৈতিক যাঁরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথগ্রহণ করবেন তাঁরা সকলেই তাঁদের স্ব স্ব পদে চাকুরিবিধির শর্তানুযায়ী যেভাবে কর্মরত ছিলেন তাঁরা সেভাবেই কর্মরত থাকবেন এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সকল জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যত্র কর্মরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ তাঁদের আওতাধীন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করবেন। এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।

স্বা : সৈয়দ নজরুল ইসলাম

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।”

মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পর্যুদস্থ পাকহানাদার বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি মুজিবনরে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহেমদের নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হয়।

পাকিস্তানের কারাগারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্তরীণ থাকায় তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যগণ অন্তহীন উদ্বেগ এবং উত্কণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। বাঙালি কূটনীতিকবৃন্দসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বন্ধু ভাবাপন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ মানুষের দাবির মুখে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি একটি বিশেষ বিমানে লন্ডন যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।

লন্ডন থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিন অর্থাত্ ১১ জানুয়ারি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার সঙ্গে হেয়ার রোডে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহ্মদের বাসভবনে দু’দফা বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি তথা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সাময়িক সংবিধান আদেশ ১৯৭২ (Provisional Constitutional Order, 1972) জারির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটি রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ হিসেবে জারি হয় ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের সাময়িক সংবিধান আদেশ-এর বাংলা ভাষ্য ছিল এরূপ:

যেহেতু ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিলের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র আদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসন পরিচালনার নিমিত্ত সাময়িক ব্যবস্থাবলী গ্রহণ করা হইয়াছে এবং যেহেতু উক্ত ঘোষণায় রাষ্ট্রপতির উপর অর্পিত হইয়াছে সকল প্রকার নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব এবং একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা এবং যেহেতু উক্ত ঘোষণায় উল্লেখিত অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ এখন সমাপ্ত হইয়াছে; এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনসাধারণের অভিব্যক্তি এবং প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা এই যে, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর হইবে এবং যেহেতু উক্ত প্রত্যাশা পরিপূরণার্থে সেই লক্ষ্যে তাত্ক্ষণিকভাবে কিছু কিছু পদক্ষেপ/ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক;

সেহেতু ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিলের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র অনুসরণে এবং সেই লক্ষ্যে প্রদত্ত, অপর সকল ক্ষমতা বলে এখন রাষ্ট্রপতি নিম্নবর্ণিত আদেশ প্রস্তুত ও জারি করিতেছেন :

এই আদেশটিকে বাংলাদেশের সাময়িক সংবিধান আদেশ, ১৯৭২ বলা হইবে।

ইহা সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী কার্যকর হইবে।

ইহা এখন হইতে বলবত্ হইবে।

সংজ্ঞা : এই আদেশে উল্লেখকৃত গণপরিষদ বলিতে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের, ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ও মার্চ মাসে জাতীয় নির্বাচনী আসনসমূহে বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দের সমাবেশ (body) কে বুঝাইবে এবং যাহারা অবশ্যই অপর কোনোভাবে বা আইন দ্বারা অযোগ্য ঘোষিত হন নাই।

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকিবে।

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি তাহার সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করিবেন।

গণপরিষদের কোনো একজন সদস্যকে, যিনি গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যবৃন্দের আস্থাভাজন, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব প্রদান করিবেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি অপর সকল মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রীকে নিয়োগ করিবেন।

গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হওয়ার পূর্বে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে মন্ত্রিপরিষদ বাংলাদেশের কোনো একজন নাগরিককে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করিবেন, যিনি গণপরিষদ প্রণীত সংবিধান অনুসারে অপর একজন রাষ্ট্রপতি নিয়োগপ্রাপ্ত ও দায়িত্ব গ্রহণ করিবার পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।

বাংলাদেশে একটি হাইকোর্ট থাকিবে, যাহাতে একজন প্রধান বিচারপতি এবং প্রয়োজন অনুসারে সময় সময় নিযুক্ত অপর কয়েকজন বিচারপতি থাকিবেন।

বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে এবং রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীবর্গ, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীবৃন্দকে শপথ বাক্য পাঠ করাইবেন। উক্ত শপথের ধরন/প্রকৃতি মন্ত্রিপরিষদ নির্ধারণ করিবেন।

তারিখ : ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২ মোতাবেক ২৬ পৌষ, ১৩৭৮

মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসরণে স্বাধীনতার সনদে (Proclamation of Independence, 10 April 1971) একটি বাক্য সংযোজন করা হয় ঃ সেটি হল “The President shall act on the advice of the Prime Minister.”

১২ জানুয়ারি ১৯৭২ (পূর্বাহ্ন) রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েমকে সাময়িক সংবিধান আদেশের ভিত্তিতে (Provisional Constitutional Order, 1972) প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ করেন।

১২ জানুয়ারি ১৯৭২ (অপরাহ্ন) প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে শপথ বাক্য পাঠ করান এবং এর পরপরই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ করেন।

বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ ঘোষণা করার পর, সাময়িক সংবিধান আদেশের ৮নং ধারা বলে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদান করা হয়। অতঃপর প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করান।

রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী Provisional Constitutional Order 1972-এর ৭ ধারা বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন।

১২ জানুয়ারি অপরাহ্নে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণ পদত্যাগ করেন।

১২ জানুয়ারি অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর (প্রধানমন্ত্রী) পরামর্শক্রমে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১১ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদকে নিয়োগদান করা হয়।

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি অপরাহ্নে প্রধানমন্ত্রী এবং ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সদস্যগণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন।

এভাবেই প্রথম রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়।

(বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় ১৩ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখের ১২০-১২৬ ক্যাব সংখ্যক বিজ্ঞপ্তি দ্রষ্টব্য।)

এসব তথ্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে পরিগণিত। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এসব ঘটনাবলি সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ যেমন জানে তেমনি বিশ্ববাসীও অবহিত রয়েছেন। ১৭ এপ্রিল তত্কালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণের শপথ গ্রহণ, ১৯৭১ সালের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ, এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস এবং এর পরবর্তি কার্যক্রম জাজ্বল্যমান সত্য। এগুলোর বাইরে কারো কোনো কথা বা ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কোথায় কে কি ব্যক্তিগত মতামত দিচ্ছে তা ইতিহাসের প্রতিপাদ্য বিষয় হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’ যা ১৫ খণ্ডে জিয়াউর রহমানের আমলেই বাংলাদেশে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। সেই ১৫ খণ্ড গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণও হয়েছে।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত দলিলপত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ব্রিটেনের বিদেশ মন্ত্রক-এর অনেক গোপনীয় নথি ও প্রামাণ্য তথ্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রকৃত তথ্য প্রমাণের উল্লেখ রয়েছে। কাজেই, কারো ভিত্তিহীন, অসত্য অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে উত্পাদিত (manufactured) তথ্য প্রচারের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা যেতে পারে কিন্তু ইতিহাসের মূল সত্য থেকে কোন ভাবেই বিচ্যুত করা সম্ভব হবে না।

তাদের এই অপচেষ্টা দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, যে বিষয়গুলি নিয়ে কোন আলোচনার অবকাশ নেই সেগুলোর উপর মিথ্যাচার করে বিকৃত ইতিহাস হঠাত্ করে কেন আলোচিত হচ্ছে? পেছনে এর গূঢ় রহস্য কোথায়? কলকাঠিই বা কে নাড়ছে? মূল হোতা কারা? গত ১৫ এপ্রিল ২০১৪, একটি দলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তার ‘নিয়োগকর্তা’ কর্তৃক উপস্থাপিত যে সকল তথ্য প্রমাণাদি দেখানো হয়েছে, সেগুলো নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই বলে দাবি করেছেন এবং এ কথাও বলেছেন, “যারা বিতর্ক করবেন তারা নব্য আধিপত্যবাদের পক্ষে কাজ করছেন বলে বিবেচিত হবেন।”

আমি যদি পাল্টা প্রশ্নকরি, যে দেশটি এবং যাদের এ দেশীয় দোসররা কোন কালেই স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব মেনে নেন নি এবং দ্রুত অগ্রসরমান বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে এর মূল ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে; প্রকৃত অর্থে তারা তাদের পক্ষ হয়েই এই মিথ্যাচার চালাচ্ছেন, তাহলে কি ভুল হবে?

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং অসংখ্য মা-বোনের ত্যাগ ও অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে এবং যে দেশ আজ সারাবিশ্বে উন্নয়নশীল দেশের মডেল বলে পরিচিত, সে দেশের ভিত্তি নিয়ে কথা বললে সেটি একদিকে যেমন জনবিরোধী ও অন্যদিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতাও বটে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক নিষ্পন্ন বিষয়। এটি বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত তথ্য। সংবিধানের কোনো বিষয়কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা গুরুতর অপরাধ। এর জন্য অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামীর লোকজন নিয়ে জিয়াউর রহমানের গঠিত দলের ব্যক্তিরা এমন সংবিধান বিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী এবং জনবিরোধী কথা বলবে, সেটাই স্বাভাবিক। এদের কেউ যদি পকিস্তান-প্রেমী সেজে এবং পাকিস্তানের আধিপত্য মেনে তাদের দাস হয়ে থাকতে চায় তা হলে তারাই বিপথগামী হিসেবে গণ্য হবেন।

লেখক : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend