হাতুরি দিয়ে মাথা থেঁতলে সাংবাদিক হত্যা

হাতুরি দিয়ে মাথা থেঁতলে সাংবাদিক হত্যা

সংবাদ প্রকাশের জের

ফেরদৌস আলী

বাসায় ফেরার পথে জামালপুরের বকশীগঞ্জে চলন্ত মোটরসাইকেল থামিয়ে সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমকে (৪৩) প্রথমে পিছ থেকে মাথায় আগাত করে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর ১৪-১৫ জনের একটি গ্রুপ তাঁকে টেনেহিঁচড়ে এলোপাতাড়ি কিলঘুসি মারতে থাকে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। মারধরে আহত নাদিমকে গুরুতর অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান।
নাদিম বাংলানিউজের জামালপুর প্রতিনিধি ও বকশীগঞ্জে একাত্তর টিভির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। ১৫ বছর ধরে স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, বকশীগঞ্জের সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম বাবু ও তাঁর ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাতের নেতৃত্বে হামলা হয়। পুলিশ ছয়জনকে আটক করলেও চেয়ারম্যান পলাতক।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, হামলার সময় চেয়ারম্যান বাবু ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি হত্যা মিশনের নেতৃত্ব দেন। হামলাকারীদের পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু তদারক করেন বাবু। পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়। হামলকারীদের মধ্যে দুটি গ্রুপ ছিল। একটি ভাড়াটে এবং আরেকটি বাবুর দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী। হামলাকারী আটজনের পরিচয় পেয়েছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও তাঁতী লীগের একাধিক নেতাও রয়েছেন। হামলাকারীদের মধ্যে ছিলেন সাধুপাড়া ইউনিয়ন তাঁতী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল, সাধুপাড়ার সাবেক এক ইউপি সদস্যের ছেলে মনির, বকশীগঞ্জ উপজেলা তাঁতী লীগের সাবেক সভাপতি রাকিব (বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক), সাধুরপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য গোলাম কিবরিয়া, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কফিল উদ্দিন, মো. তোফাজ্জেল, আইনাল হক, শহীদ ও ফজলু। তাঁরা সবাই চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, যে স্থানে প্রথমে হামলা করা হয়েছে সেটি সিসি ক্যামেরার আওতাধীন। এটা হামলাকারীরা জানতেন। তাই প্রথমে সেখানে মারধর করার পর সিসি ক্যামেরার আওতার বাইরে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বেদম পিটুনি দেওয়া হয়। হাতুরি ও ইট দিয়ে তাঁর মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। হামলাকারীদের কারও পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট, কারও ছিল লুঙ্গি। হামলার ঘটনা শোনার পর স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ঘটনাস্থলে দৌড়ে গিয়ে নাদিমকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁদের বক্তব্য নিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্র বলছে, বাবু অনেক আগে থেকেই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। পুলিশ প্রশাসনের সাবেক এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার চাচাতো ভাই তিনি। তাঁর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বৈধ-অবৈধ নানা কাজে কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তার ছায়ায় থাকায় কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পেত না। অল্প সময় প্রচুর অর্থবিত্তের মালিকও হন বাবু।
প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, নাদিম অত্যন্ত সাহসী সাংবাদিক ছিলেন। অনিয়ম-অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতেন না।
বকশীগঞ্জের নীলক্ষীয়া ইউনিয়নের গোমেরচর গ্রামে জন্ম নেওয়া সাংবাদিক নাদিম স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে উপজেলা শহরের কাচারিপাড়া এলাকায় একটি বাসায় বসবাস করতেন। তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন রিফাত ডিগ্রিতে, মেয়ে রাব্বিলাতুল জান্নাত অনার্সে ও ছোট ছেলে রিশাদ আবদুল্লাহ প্রথম শ্রেণিতে পড়ালেখা করে।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বুধবার ময়মনসিংহ থেকে সন্ধ্যায় বকশীগঞ্জের বাসায় ফেরেন নাদিম। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯টার দিকে বাসা থেকে বকশীগঞ্জ বাজারে যান তিনি। রাত ১০টার দিকে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় বকশীগঞ্জ সরকারি কলেজ মোড় এলাকায় মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে দুর্বৃত্তরা তাঁর ওপর হামলা করে। এরপর নাদিমকে অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে বকশীগঞ্জ ও পরে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। তবে অবস্থার উন্নতি না হলে গতকাল সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখানে দুপুর আড়াইটার দিকে মারা যান নাদিম।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ শাহ কামাল আকন্দ বলেন, সুরতহালে নিহতের কপালের বাঁ দিকে কাটা জখম পাওয়া যায়। আঘাতজনিত কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
গতকাল বিকেলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশঘরের সামনে আহাজারি করেন নিহতের স্ত্রী ও সন্তানরা। নিহতের মেয়ে রাব্বিলাতুল জান্নাত বলেন, ‘নিউজ করার জেরে আমার বাবাকে ইউপি চেয়ারম্যান বাবুর নেতৃত্বে বাসায় ফেরার পথে চলন্ত গাড়ি থেকে টেনে নিয়ে চেয়ারম্যানের ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাত, চেয়ারম্যানের কর্মী মনিসহ অন্যরা মারধর করে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে। অচেতন অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। চেয়ারম্যান বাবুর নেতৃত্বে আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে।’
নিহতের স্ত্রী মনিরা বেগম বলেন, আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। একজন সাংবাদিকের কাজ হলো সত্য প্রকাশ করা। এই সত্য লিখতে গিয়ে যদি সাংবাদিক হত্যা হয়, সেই হত্যার বিচার চাই। যেন আর কোনো সাংবাদিকের শরীরে হাত না দিতে পারে– এমন বিচার চাই।
স্থানীয় ও নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, কৌশলে ফাঁদ পেতে সাবিনা ইয়াসমিন নামে এক নারীকে বিয়ে করেন বাবু। তাঁদের সংসারে এক কন্যাসন্তান হওয়ার পর চলতি বছরের ৮ মে তালাক দেওয়া হয় ওই নারীকে। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিক নাদিমসহ বকশীগঞ্জের আরও দু’জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ১৭ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আদালতে মামলা হয়। ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত মামলাটি ৩০ মে খারিজ করে দেন। বুধবার নাদিম ময়মনসিংহে সাইবার ট্রাইব্যুনালে গিয়ে মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।
চেয়ারম্যানের করা মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে নাদিম গত বুধবার একটি অনলাইন পোর্টালে সংবাদ প্রকাশ করে নিজের ফেসবুকে শেয়ার করেন। নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দেন। মূলত মামলা করেও সাংবাদিককে ঘায়েল করতে না পারায় চেয়ারম্যান বাবুর লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
ঘটনার পরপর পুলিশ আশপাশ থেকে সিসি টিভির ফুটেজ দেখে কয়েকজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে। সিসি টিভির ফুটেজে দেখা যায়, হামলায় নেতৃত্ব দেন বাবুর ব্যক্তিগত সহকারী ও চেয়ারম্যান বাহিনীর প্রধান রেজাউল করিম। ইতোমধ্যে ছয়জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন বকশীগঞ্জ থানার ওসি সোহেল রানা। তিনি আরও জানান, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন– সুমন মিয়া, তোফাজ্জল হোসেন, আইনাল মিয়া ও কফিল উদ্দিন।
একাধিক সূত্র বলছে, ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধ ছাড়াও হত্যার পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা– তা নিয়েও তদন্ত চলছে। তিনি বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি নিয়েও সংবাদ প্রকাশ করেন। বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তান– এমন তথ্য দিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা লিখিত অভিযোগ ও প্রতিবাদ করলে তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন নাদিম। এর জেরে উপজেলা আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত উপজেলা যুবলীগ নেতা শামীম খন্দকার ও যুবলীগ কর্মী ইসমাইল হোসেন মণ্ডল তালুকদারের নেতৃত্বে এর আগে হামলা হয়েছিল নাদিমের ওপর। এই ঘটনায় নাদিম থানায় অভিযোগ দিলে পরে সাংবাদিকদের মধ্যস্থতায় বিষয়টির সমাধান হয়।
জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। হামলাকারীরা যত প্রভাবশালী হোক কোনো ছাড় পাবে না।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগম বলেন, এ হত্যার ঘটনা দুঃখজনক। তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
এদিকে ঘটনার পর থেকে এলাকাছাড়া বাবু। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
নাদিমের মৃত্যুর পর জামালপুর জেলাসহ সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে। দুপুরে জামালপুর প্রেস ক্লাবে নাদিম হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা থেকে তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে বকশীগঞ্জ প্রেস ক্লাবও বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। হত্যার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend