থাই জঙ্গলে নারীদের উপর চলতো পাশবিক নির্যাতন

থাই জঙ্গলে নারীদের উপর চলতো পাশবিক নির্যাতনমালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ডের শংখলা জঙ্গলে পাচারের শিকার নারীদের উপর দিনের পর দিন চলেছে মধ্যযুগীয় কায়দায় পাশবিক নির্যাতন। রোহিঙ্গা নারীদের আটকে রেখে ভোগ করতো মানব পাচার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এ সিন্ডিকেটের সদস্য হাতেগোনা কয়েকজন। তারাই নির্যাতন করতো রোহিঙ্গা নারীদের। শংখলা প্রদেশের পাটাংবাচা জঙ্গলের রাবার শ্রমিক ও রোহিঙ্গারা ইত্তেফাকের প্রতিনিধিকে এ তথ্য জানান। জঙ্গলে নারীদের উপর নির্যাতনের নেপথ্যে রয়েছেন রোহিঙ্গা দালাল, বার্মিজ মুন, কিরিং ও শ্যাম সম্প্রদায়ের মাফিয়ারা। তবে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে থাই সরকারের যৌথ অভিযানে গা-ঢাকা দিয়েছে মানব পাচারকারীরা। যদিও মাফিয়া রোহিঙ্গা আনোয়ারসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে থাই প্রশাসন।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে দাঙ্গার পর থেকে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে সপরিবারে দেশত্যাগে বাধ্য করে সরকার। তখন থেকে মিয়ানমারের নৌ-বাহিনীর সহায়তায় ‘ঠিকানাবিহীন’ রোহিঙ্গারা নৌকায় করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে আসছে। ওই নৌকায় কিছু বাঙালিকেও ফুসলিয়ে আনা হতো। আর ওই জঙ্গলে আগে থেকে অবস্থান করতো রোহিঙ্গা ও বার্মিজ দালাল-মাফিয়ারা। যারা চাহিদা মতো অর্থ পেলে গভীর রাতে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দিতো। কিন্তু নারী হোক আর পুরুষ কেউ তাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতেন না। গত পহেলা মে মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে সারাবিশ্বে হৈচৈ পড়ে যায়। মূলত রাবার শ্রমিকদের কল্যাণে এ গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়।

শংখলার পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে রাবার শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন এমন ৬ জন ব্যক্তির সঙ্গে গত দুদিন ধরে দোভাষীর সহায়তায় কথা বলেন এ প্রতিনিধি। যদিও তাদের উপর জঙ্গলের কার্যক্রমের বিষয়ে মুখ না খোলার নির্দেশনা রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, গত প্রায় দু’বছর যাবত্ মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী জঙ্গলে নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে আসছে। প্রতিদিন রাতে তারা জঙ্গলে নারীর কান্না শুনতে পেতেন। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিল না।

তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা রাত ১২টা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত এই জঙ্গলে রাবার শ্রমিক হিসাবে কাজ করে আসছি। মোটর সাইকেল নিয়ে জঙ্গলের গভীরে সংঘবদ্ধভাবে যেতেন এ শ্রমিকরা। ৫ থেকে ১০ জন একেকটা টিমে ভাগ করে কাজ করেন তারা। কিন্তু এ জঙ্গলে নারীদের নিয়ে এতো অমানবিক কাজ হতে পারে তা তাদের ভাবনায় ছিল না।

শ্রমিকরা বেশ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, জঙ্গলের গভীরে দূর থেকে তারা দেখতেন একটি জায়গায় ক্যাম্প করে অনেকগুলো মানুষকে বসে বা শুইয়ে রাখা হয়েছে। তাদের পাশে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে চার থেকে পাঁচজন। কারোর কারোর হাতে লাঠি দেখতেন। যেগুলো দিয়ে ওই মানুষগুলোকে পেটানো হতো। তাদের নির্যাতনের শব্দ শোনা যেত দূর থেকেও। আর নারীদের পাশে পর্দার মতো কিছু টাঙ্গিয়ে আলাদা করে রাখা হতো। সেখানে নারীদের বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করতো নরপিশাচগুলো। নারী কণ্ঠে ডুকরে ডুকরে কান্নার শব্দ পেতেন তারা। ধর্ষণকারীদের হাতে বোতলের মতো কিছু একটা থাকতো। জঙ্গলের অনেক জায়গায় তারা রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছেন বলে জানান। এ বছরের শুরুর দিকে তারা দেখতে পান, অস্ত্রধারী লোকগুলো জঙ্গলে বড় গর্ত করে অনেকগুলো মানুষকে একসঙ্গে মাটি চাপা দিচ্ছে। যেটা তাদের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। প্রতিরাতে জঙ্গলে বিভিন্ন পয়েন্টে গণকবরের জন্য গর্ত করতো পাচারকারীরা। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শ্রমিকরা।

চোখের সামনে এসব দেখার পরও প্রতিবাদ করতেন না কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, আমরা কখনো প্রতিবাদ করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। মনে করতাম তারা প্রশাসনের লোক হতে পারে। এতে আমাদের কোন সমস্যা হয় কিনা। তবে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে জঙ্গলে ঘটা নির্যাতনের বিষয়গুলো আমাদের বৌদ্ধ মালিকদের অবগত করলাম। এরপর বৌদ্ধ মালিকরা স্থানীয় মুসলিম কমিটিকে সঙ্গে নিয়ে বিষয়টি সরকারকে অবগত করে। এরপর শুরু হয় গণকবর উদ্ধার অভিযান। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী গণকবরগুলো উদ্ধার করা হয়। তারা যেখানে যেখানে গণকবর দিতে দেখেছেন, সেখানকার কথা সেনাবাহিনীকে বলেছেন। সেখান থেকে প্রায় ৭০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর লাশও ছিল। বর্তমানে পাটাংবাচার স্থানীয়দের সহায়তায় মুসলিম কমিটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে গণকবর থেকে উদ্ধার লাশগুলো দাফন করেছে।

জঙ্গল থেকে কৌশলে পালিয়ে আসা দু’জন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, মিয়ানমার আমাদের জায়গা দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে সপরিবারে অবৈধ পথে আমাদের আসতে হয়েছে। মিয়ানমার নৌ-বাহিনীর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন ও কিছু বাংলাদেশি আনার শর্তে নৌকাগুলো থাইল্যান্ড উপকূলে ভিড়তে দিতো। থাই উপকূলে মানব পাচারকারীদের এজেন্টরা তাদের জঙ্গলে নিয়ে যেতো।

জঙ্গলে নির্যাতনের বিষয়ে তারা জানান, টাকা দেয়ার পরও নারীদের উপর যৌন নির্যাতন ছিল অনিবার্য। প্রত্যেক নারীকে স্বামী-সন্তানের সামনেই দালাল-মাফিয়ারা নির্মমভাবে ভোগ করতো। নারী ভোগ বা পুরুষের নির্যাতনের আগে প্রতিটি ক্যাম্পে এক বা দু’জনকে মেরে ফেলে আতংক সৃষ্টি করতো দালালরা। চাহিদা মতো টাকা দিলে ওই ক্যাম্প থেকে মুক্তি মিলতো ভুক্তভোগীদের। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তারা।

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend