প্রিয় অনন্ত… মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সকালে একটা ক্লাস শেষ করে এসে অফিসে মাত্র বসেছি, তখন আমার একজন সহকর্মী এসে আমাকে জানাল অনন্তকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। তারা তিন ভাই-বোন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে, অনন্তর বড় বোন আমার সরাসরি ছাত্রী। পাস করে দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে একটা প্রজেক্টে কাজ করেছে। অনন্তের খবরটি শুনে আমি এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করলাম।

হাসপাতালে যেতে যেতে খবর পেলাম পোস্টমর্টেম করার জন্য অনন্তকে মর্গে নেওয়া হয়েছে। শুনে অনেকে অবাক হতে পারে; কিন্তু ওসমানী হাসপাতালের এই মর্গে আমি অনেকবার এসেছি। আমি ও আমার স্ত্রী এখানে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রছাত্রীর যখন অপঘাতে মৃত্যু হয় বা আত্মহত্যা করে তখন সবার অজান্তে একটি নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া শুরু হয়। মৃত ছেলেটি বা মেয়েটির মৃতদেহটি পুলিশি প্রক্রিয়ার লাল ফিতা থেকে মুক্ত করে তাদের আপনজনের হাতে তুলে দিতে হয়। কাজটি খুব সহজ নয়, আমি ও আমার স্ত্রী মিলে অনেকবার করেছি। তাই হাসপাতালে গিয়ে পোস্টমর্টেমের ঘর খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সেখানে অনেকে ম্লান-বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। অনন্তর ভগ্নিপতির সঙ্গে দেখা হলো, তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিলে অনন্তকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় করে হাসপাতালে এনেছেন। কোনো অ্যাম্বুল্যান্স নয়, কোনো গাড়ি নয়- একটি সিএনজি অটোরিকশা। ভগ্নিপতি জানালেন, অনন্তকে কোনোমতে অটোরিকশায় তোলার পর হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল নিচে তার একটা কাটা আঙুল পড়ে আছে- সেটাও তুলে এনেছেন। আতঙ্কিত মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, কেউ কাছে আসে না। অনেক কষ্টে একটা গামছা জোগাড় করে সেটা দিয়ে তার ছিন্নভিন্ন মাথাটি বেঁধে এনেছেন; যে মাথার ভেতর একটি মস্তিষ্কে একজন অত্যন্ত মেধাবী, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক হৃদয়বান ও আধুনিক মানুষ গড়ে উঠছিল।

অনন্তর ভগ্নিপতির কাছে জানতে পারলাম, অনন্ত তার জীবনের শেষ লেখাটি লিখেছে আমার জন্য। সিলেটের একজন এমপি আমাকে নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন, অনন্ত সেই মন্তব্যগুলোর প্রতিবাদ করে খুবই গুছিয়ে একটা লেখা লিখে তার কম্পিউটার থেকে আপলোড করে ঘর থেকে বের হয়েছে কাজে যাওয়ার জন্য। বড় রাস্তায় তাকে চারজন মুখোশধারী মানুষ ধারালো চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করেছে। অনন্ত তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার বাসার দিকে ছুটে যাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত যেতে পারেনি। বাসার কাছাকাছি একটা পুকুরপাড়ে লুটিয়ে পড়েছে- চারজন মানুষ তাকে সেখানে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তার দুটি হাত কবজি থেকে আলাদা করে ফেলেছে; যে হাত দিয়ে সে বিজ্ঞানের কথা লিখত, দেশের কথা লিখত, স্বপ্নের কথা লিখত; যে হাত দিয়ে সে একটু আগে আমার জন্য তার ভালোবাসাটুকু প্রকাশ করেছে।

পোস্টমর্টেম করে তার দেহটি একটা সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে করে তার বাসায় এনেছে। আমরা তার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় এসেছি। খুব ভালো করে জানি তার মা-বাবা, ভাই-বোন কাউকে সান্ত্বনা দিয়ে বলার মতো একটি শব্দও নেই, তার পরও এসেছি তাদের সামনে মাথা নিচু করে থেকে এই সময়, এই দেশে জন্মানোর অপরাধের গ্লানিটুকু তাদের সামনে মাথা পেতে নেওয়ার জন্য।

অনন্তর বাবা শূন্যদৃষ্টিতে বিছানায় শুয়েছিলেন, মস্তিষ্কে স্ট্রোক করার পর অনেকটাই অসহায়। চারপাশে কী হয় বুঝতে পারেন না, আমরা যখন গেছি তখনো সন্তানের মৃত্যুর খবরটি বুঝতে পারেননি। মাও খুবই অসুস্থ, অনন্তই তার মা-বাবাকে দেখে রাখত। আজকেও মা-বাবার সেবাটুকু শেষ করে কাজে বের হয়েছিল। অনন্তর দেহটি বারান্দায় শুইয়ে রাখা হলো, মুখের কাপড়টি খুলে দেওয়ার পর আমরা শেষবার তাকে দেখতে পেলাম। পুরোপুরি রক্তশূন্য ফ্যাকাসে একটি দেহ; কিন্তু তার মুখমণ্ডলে আশ্চর্য এক ধরনের প্রশান্তির ছাপ। এই নিষ্ঠুর পৃথিবী ও তার চেয়েও নিষ্ঠুর মানুষের বিরুদ্ধে সেই মুখে কোনো অভিযোগ নেই।

একজন আমাকে তার ঘরটি দেখাল, টেবিলের ওপর স্তূপ করে রাখা বই। অনন্ত পড়তে ভালোবাসত, লিখতে ভালোবাসত, একটা পত্রিকার সম্পাদনা করত। অনন্তকে অচিন্তনীয় নিষ্ঠুরতায় হত্যা করা হয়েছে। তার অপরাধ সে বিজ্ঞানকে ভালোবাসত, যুক্তিতে বিশ্বাস করত এবং সম্ভবত সবচেয়ে বড় অপরাধ যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জন্ম নেওয়া গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে তার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

অনন্তর বাসায় জানতে পারলাম যেদিন তাকে হত্যা করা হয়েছে, ঠিক সেদিনই তার সুইডেনে একটা কনফারেন্সে বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। সমমনা মানুষদের সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটাতে সে ভিসার আবেদন করেছিল। সুইডেন তাকে ভিসা দেয়নি- যদি ভিসা পেয়ে যেত, তাহলে তাকে হয়তো এভাবে মারা যেতে হতো না। সুইডেন নামের এই রাষ্ট্রের জন্য এখন আমার ভেতরে বিতৃষ্ণা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

২.

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়। পুলিশ তাদের হত্যাকারীদের দ্রুত ধরে ফেলেছিল। সম্ভবত সে কারণে অনেক দিন এ রকম ঘটনা ঘটেনি। প্রায় দীর্ঘ দুই বছরের বিরতি দিয়ে অভিজিৎ রায়কে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে হত্যা করা হয়। তাঁর হত্যাকাণ্ড চলাকালে খুব কাছে বসে থাকা পুলিশের এক ধরনের নির্লিপ্ত ভূমিকা আমাদের সবাইকে খুব বিস্মিত করেছিল। আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন, আমি সেই ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি পুলিশ চাইলে যেকোনো অপরাধীকে ধরে ফেলতে পারে। অভিজিতের হত্যাকারীদের কিন্তু এখনো ধরা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, আমরা আবিষ্কার করলাম, সরকার অভিজিৎ থেকে একটা নিরাপদ দূরত্বে থাকছে। ধর্মান্ধ মানুষই হোক আর মুক্তচিন্তার মানুষই হোক- সবার দায়িত্ব কিন্তু সরকারের নিতে হবে। কিন্তু এক বিচিত্র কারণে সরকারের ধারণা হয়েছে অভিজিতের মতো মুক্তচিন্তার মানুষের জন্য সহমর্মিতা দেখালে যারা ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করে তাদের হাতে একটা সুযোগ তুলে দেওয়া হবে। সরকার ধর্ম নিয়ে কারো হাতে কোনো সুযোগ তুলে দেবে না বলে পণ করেছে।

এর ফলে জঙ্গিদের সাহস বেড়েছে, অভিজিৎকে হত্যা করার এক মাসের মধ্যে তারা ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করেছে। এবারও পুলিশ নির্লিপ্ত; কিন্তু দুঃসাহসী পথচারী দুজন হত্যাকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে। (যতবার এই দুঃসাহসী পথচারীদের কথা উল্লেখ করা হয় ততবার তাদের দৈহিক গঠনের বিষয়টি সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়- কোনো একটা বিচিত্র কারণে আমরা ভুলে যেতে বসেছি যে তাদের আসল পরিচয় যে তারা আমাদের মতো মানুষ!) এত দিনে আমরা আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি হেফাজতে ইসলাম থেকে স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে যে ৮৪ জন ব্লগারের নাম দেওয়া হয়েছে, এই সরকার তাদের পরিত্যাগ করেছে। এই রাষ্ট্রের কাছে তারা দেশের অধিবাসী নয়, তাদের মূল পরিচয় হচ্ছে তারা অভিশপ্ত ব্লগার। এ বিষয় নিয়ে আমাদের যেটুকু সন্দেহ ছিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সেটুকুও নিরসন করে দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনন্তকে হারালাম। এখন আমরা সবাই জানি, এই অভিশপ্ত ব্লগারদের একজন একজন করে হত্যা করা হলেও সরকার একটুও বিচলিত হবে না! একজন মানুষকে হত্যা করতে হলে প্রথমে তাকে নাস্তিক বলে ঘোষণা করতে হবে, কিছুদিন প্রচারণা চালাতে হবে, তারপর তাকে হত্যা করা হলে সরকার টুঁ শব্দটি করবে না।

এখানে দুটি বিষয় লক্ষ করার মতো। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, যাদের হত্যা করা হচ্ছে সব সময়ই তাদের প্রথমে নাস্তিক হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। আমি সামাজিক নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করি না, তাই কে কোন ব্লগে কী লিখেছে সেটা আমি জানি না। অনন্তকে হত্যা করার পর আমি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম তাকে নাস্তিক বলার পেছনে আসলেই কোনো কারণ আছে কি না। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি সবাই আমাকে জানিয়েছে অনন্তর লেখালেখি ছিল বিজ্ঞান নিয়ে। সে যুক্তি নামে একটা ম্যাগাজিন সম্পাদনা করত, ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর কথা লিখত না। কে জানে হয়তো যুক্তি দিয়ে কথা বলাটিই অনেক বড় অপরাধ- যারা তাকে হত্যা করেছে তারা নিশ্চয়ই যুক্তিহীন অন্ধকার ধর্মান্ধ একটি দেশ তৈরি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যারা অনন্তকে হত্যা করেছে তাদের চোখে একটি বিষয়ে নিশ্চিতভাবে অনেক বড় অপরাধী, সেটি হচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলনের একজন কর্মী। এই দেশে মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করা কারো কারো চোখে সেটি অনেক বড় একটি অপরাধ।

দ্বিতীয় আরো একটি বিষয় আমাকে খুবই বিচলিত করছে। সেটি হচ্ছে এই হত্যাকারীরা যে গোপনে এসে একজনকে হত্যা করে আবার গোপনে সবার চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে তা নয়। তারা যাদের হত্যা করছে তাদের কিন্তু মোটামুটি প্রকাশ্যেই ভয়ভীতি দেখিয়ে এসেছে। ভবিষ্যতে যাদের হত্যা করবে তাদেরও আবার ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেছে। পুলিশের কাছে কোনো ‘ক্লু’ নেই, তারা কাউকে ধরতে পারছে না সেটি কিন্তু সত্যি নয়। সত্যি সত্যি যদি হত্যাকারীদের ধরার জন্য আন্তরিক ইচ্ছা থাকত, তাহলে তদন্ত করার জন্য অনেক তথ্যই কিন্তু আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যেকোনো কারণেই হোক, পুলিশ বা সরকারের যে এই দুর্ভাগা ব্লগারদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই সবাই সেটি জেনে গেছে। তাই কোনো একজন যখন নিশ্চিতভাবে হত্যার হুমকি পাচ্ছে তখনো সে সাহায্যের জন্য পুলিশের কাছে যাওয়ার সাহস পায় না।

৩.

ব্লগ শব্দটি নিয়ে মনে হয় এ দেশের সাধারণ মানুষকে খুবই ভুল ধারণা দেওয়া হয়েছে! ব্লগার শব্দটি দিয়ে একজন মানুষকে গালি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তির জগতে ব্লগ লেখা বলতে বোঝানো হয় অনেকটা ব্যক্তিগত ডায়েরি লেখার মতো। আমরা কেউ যদি আমার ব্যক্তিগত ডায়েরিটি সবাইকে পড়তে দিতাম, তাহলে সেটা হতো অনেকটা ব্লগ লেখার মতো। কেউ যখন তার খাতায় বা নোট বইয়ে ডায়েরি লেখে তখন সে ইচ্ছা করলেও একসঙ্গে অনেককে দেখাতে পারে না; কিন্তু ইন্টারনেটের জগতে সেটা পানির মতো সোজা। একজন মানুষ ব্লগে কিছু একটা লিখে পৃথিবীর সবাইকে সেটা দেখার সুযোগ করে দিতে পারে। সারা পৃথিবীতে এ মুহূর্তে এক-দুজন নয়, হাজার হাজার বা লাখ লাখও নয়, আক্ষরিক অর্থে কোটি মানুষ ব্লগ লেখে- যার অর্থ এ পৃথিবীতে এখন কোটি কোটি ব্লগার! কাজেই ব্লগার বলে একজন মানুষকে কিভাবে গালি দেওয়া যায় সেটা কোনোমতেই আমার মাথায় ঢোকে না। একজন মানুষকে ‘এমএ পাস’ বলে গালি দিলে যে রকম হাস্যকর শোনায়, ব্লগার বলে গালি দিলেও সেটা একই রকম হাস্যকর শোনায়।

আজকাল নাস্তিক ও ব্লগার দুটি শব্দকে সমার্থক করে ফেলার জন্য খুবই চেষ্টা করা হচ্ছে! অথচ মজার ব্যাপার হলো, যদি আমাদের কখনো ইসলাম ধর্ম (বা অন্য কোনো ধর্ম) নিয়ে কোনো জরুরি তথ্য বা বিশ্লেষণের দরকার হয়, তখন আমরা সেটা খুঁজে পাই কোনো একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ব্লগারের লেখা থেকে! যারা তাদের অপছন্দের মানুষদের ব্লগার বলে গালি দেয়, তাদের জানা দরকার ইন্টারনেটে শুধু ইসলাম ধর্মের ওপরই অসংখ্য ব্লগ আছে। অসংখ্য খাঁটি মুসলমান ব্লগার আছেন।

সবার ব্লগই যে সাধারণ মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়ে তা নয়। ইন্টারনেটে অসংখ্য অর্থহীন অপ্রয়োজনীয় ব্লগ রয়েছে। একটা খবরের কাগজ যখন প্রকাশিত হয় তখন তার প্রকাশক আর সম্পাদকের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে, তাঁরা যেটা খুশি সেটা ছাপিয়ে ফেলতে পারেন না। ইন্টারনেটের জগতে নিজের লেখা প্রকাশ করার প্রক্রিয়াটা এত সহজ করে ফেলা হয়েছে যে এখানে যার যেটা ইচ্ছা সে সেটাই প্রকাশ করে ফেলতে পারে। মানুষটি যদি নিজে থেকে তার লেখালেখির ওপর এক ধরনের দায়বদ্ধতা বসিয়ে না দেয়, তাহলে আর কিছুই করার নেই। আমরা এর একটা অশুভ রূপ এর মধ্যেই দেখতে শুরু করেছি। আমরা দেখেছি, একজন মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে চট করে আরেকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে না, অশালীন কথা বলে না, গালাগালও করে না। কিন্তু ইন্টারনেটের জগতে অবলীলায় একে অন্যকে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করতে সংকোচ বোধ করে না।

আমরা সবাই দেখছি নতুন প্রজন্মের যারা আধুনিক মনের মানুষ, যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে তাদের সঙ্গে অন্ধকার জগতের মানুষদের এক ধরনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, সেটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে খুবই স্পষ্ট। তাই নতুন প্রজন্মের আধুনিক তরুণ-তরুণীদের আমি প্রায় হাতজোড় করে অনুরোধ করব, তারা যেন সুন্দর ভাষায় লেখে। তারা যেন কিছু একটা লিখে অকারণে কারো মনে কষ্ট না দেয়। কেউ যখন আমাকে আমার প্রিয় উক্তিটির কথা জিজ্ঞেস করে, আমি সব সময় তাদের ওমর খৈয়ামের কবিতার একটা লাইন শুনিয়ে দিই, ‘কারো মনে দুঃখ দিও না করো বরং হাজার পাপ’। যার অর্থ কারো মনে দুঃখ দেওয়া হাজার হাজার পাপ করা থেকেও বড় পাপ।

আমি লিখতে বসে আজকে অনন্ত বিজয়ের অভাবটি খুব তীব্রভাবে অনুভব করছি। সে কখনো কোনো মানুষের মনে দুঃখ দেয়নি। সে তার অসুস্থ মা-বাবার সেবা করে গেছে। অনন্ত বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও তার সংক্ষিপ্ত জীবনটিতে বিজ্ঞানের জন্য কাজ করে গেছে। খুবই কোমল স্বভাবের মানুষ- তার আপনজনের কাছে শুনেছি- কোথাও পা ফেলার সময় যদি দেখেছে সেখানে একটা পিঁপড়া, সে তার পা-টা অন্য জায়গায় ফেলে পিঁপড়াটাকেও রক্ষা করেছে।

অথচ সেই মানুষটাকে কী অবলীলায় কিছু নিষ্ঠুর মানুষ মেরে ফেলল!

অনন্ত, তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।

লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও

প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend