হরতাল ‘মুক্ত’ দেশ : স্বস্তিতেও রাজধানীজুড়ে যানজট

Hartal-free_Dhakaবিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ধারাবাহিক অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি থাকলেও বুধবার থেকে নতুন কর্মসূচি আসেনি। আর এতে করে জনমনে অনেকটায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। স্বাভাবিক হয়ে এসেছে জনজীবন। তবে স্বস্তির এমন দিনেও রাজধানীতে ছিল তীব্র যানজট।
চলতি সপ্তাহের প্রথম তিন দিন হরতাল কর্মসূচি থাকলেও শেষের দুইদিন অর্থাৎ বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতাল কর্মসূচি দেওয়া থেকে বিরত থাকে বিএনপি।
বুধবার (২৫ মার্চ) ২০ দলীয় জোটের হরতাল কর্মসূচি না থাকায় জনজীবনে কেমন প্রভাব পড়ছে জানতে চাইলে এলিফ্যান্ট রোডের জুম অপটিকস নামের চশমা দোকানের মালিক মো. রাজু বলেন, ‘আজ হরতাল নেই, তাই অনেকদিন পর আমি বাসে করে দোকানে এসেছি। তবে আজ রাস্তায় অনেক যানজট রয়েছে। আমার বাসা থেকে আসার পথে প্রতিটি সিগন্যালেই যানজট ছিল। গতকালও এমন অবস্থা ছিল না। তবে আজ মনে অতটা ভয় ছিল না।’
একই বিষয়ে কথা হয় ছবি বাঁধাইয়ের প্রতিষ্ঠান ‘ফটো কিং’র স্বত্বাধিকারী শেখ নাসির হোসেনের সঙ্গে।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে সবসময়ই রিকশাযোগে নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আসেন নাসির। হরতাল চলাকালে আসার পথে (হাজারীবাগ সেকশন-আজিমপুর-নিউমার্কেট) তেমন কোনো যানজট না থাকলেও আজ মাঝপথে তাকে রিকশা থেকে নেমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়েছে।
নাসির বলেন, ‘হরতালে বাসা থেকে প্রতিদিন আমি রিকশায় করে দোকানে এসেছি। কিন্তু আজ হরতাল ছিল না বলে দোকান পর্যন্ত রিকশা নিয়ে আসতে পারিনি। আমি যে রাস্তায় আসি ওই পথে হরতালের সময় প্রাইভেটকার চলাচলও কম ছিল। স্কুলগুলোতে রিকশায় করে বাচ্চাদের আনা হতো। কিন্তু আজ সকালে এ রাস্তায় অনেক প্রাইভেটকার ছিল। এতে করে রিকশাগুলো জ্যামে আটকে যায়। আমি আজিমপুর কবরস্থানের সামনে রিকশা থেকে নেমে দোকান পর্যন্ত আজ হেঁটে এসেছি।’
চলতি বছর ৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বাধা দেওয়া হয়। তার গুলশান কার্যালয়ের প্রবেশ পথে বালি ও ইট-খোয়া ভর্তি ট্রাক এবং অন্যান্য যানবহন দিয়ে ব্যারিকেড বসায় পুলিশ।
কর্মসূচির দিন দুপুরে কার্যালয় থেকে বের হতে চাইলে প্রধান ফটকে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে রাখে পুলিশ। পরে কার্যালয়ের মধ্যে থাকা বিএনপির চেয়ারপারসন ও নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে পিপার স্প্রে ছোড়ে পুলিশ। কর্মসূচিতে যোগদানে বাধা দেওয়ায় ওই দিন লাগাতার অবরোধের ঘোষণা দেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে সপ্তাহে ৫ কর্মদিবসের প্রায় প্রত্যেক দিনই হরতাল আহ্বান জানায় তারা।
২০ দলের ঘোষিত কর্মসূচিতে প্রথম দিকে রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা ঘটতে থাকে। ককটেল বিস্ফোরণ, যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ এবং ভাংচুরের ঘটনা ঘটতে থাকে। এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তি রাজনৈতিক সহিংসতা ও পেট্রোলবোমায় নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটসহ সারাদেশের অন্যান্য হাসপাতালে বাড়তে থাকে পেট্রোলবোমায় দগ্ধদের সংখ্যা।
৬ জানুয়ারি থেকে চলমান অবরোধ ও হরতালে জন জীবনে চরম ভীতির সৃষ্টি হয়। দিনে ও রাতে কমতে থাকে দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন। অন্যদিকে নাশকতা ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়।
নাশকতা ঠেকাতে পুলিশের পক্ষ থেকে রাতে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস চালাতে নিষেধ করা হয় পরিবহন মালিকদের। সারাদেশের মতো রাজধানীতেও চলমান কর্মসূচির প্রভাব দেখা যায়।
রাজধানীতে গণপরিবহনের চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ের যান চলাচল একপ্রকার বন্ধই ছিল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে আর নগর জীবনও স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তারপরও হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা থাকায় রাজধানীতে পুলিশি পাহারা আগের মতো রাখা হয়। আর যানবহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের আতঙ্ক নগরবাসীর মধ্যে তখনও ছিল।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধের মতো নতুন কর্মসূচি না থাকার ব্যাপারটি সঠিক সিদ্ধান্ত মন্তব্য করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘হরতালকে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সাংবিধানিক অধিকার বলা হলেও কার্যত আমরা দেখেছি এই কর্মসূচিটা নাশকতা ও সহিংসতা নির্ভর হয়ে উঠেছিল। শান্তিপূর্ণ হরতাল বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও আমরা দেখেছি যানবাহনে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এতে জনমনে ভীতির সৃষ্টি হয়। ক্ষতির ভয়ে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত পরিবহনের মালিকরা রাস্তায় যানবহন কম বের করেছে। আবার সাধারণ নগরবাসীও ছিল আতঙ্কিত।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিএনপির এমন ধারাবাহিক কর্মসূচির ফলে হরতাল অনেকটা অকার্যকর কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। এমন কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায় হয় না বলে জনগণের মনে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও দেরি করে হোক আর যেভাবে হোক বিএনপি তাদের এমন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ দুইমাসের অধিক চলা এ কর্মসূচিতে শেষের দিকে জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে মনে হলেও তা কতটুকু স্বাভাবিক হয়েছিল তার প্রমাণ আজ (বুধবার) দেখা গেছে। রাজধানীতে বুধবার তীব্র যানজট দেখা গেছে। এতে বোঝা যায়, হরতাল কর্মসূচি না থাকায় জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। লোকজন নিশ্চিন্তে বাইরে বের হচ্ছে।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার মহান স্বাধীনতা দিবস। বিএনপি দিনটিকে পালনের জন্য হরতাল প্রত্যাহার করেছে এ জন্য তাদের অভিনন্দন। তবে তারা যেন ভবিষ্যতে এমন সহিংসতা নির্ভর কর্মসূচি না দেয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এ ধরনের কর্মসূচি বিএনপিকে অনেকটায় জনবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল।’

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend