আন্দোলন নিয়ে উভয় সঙ্কটে ২০ দলীয় জোট

bnpসরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। চলমান অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি যেমন প্রত্যাহার করতে পারছে না, তেমনি এ কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদেরও তেমন করে মাঠে নামাতে পারছেন না জোটের শীর্ষ নেতারা। এ অবস্থায় ‘আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল’ সরকারের পতন বা সংলাপের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত আরেকটি জাতীয় নির্বাচন আসলেই আদায় করা সম্ভব হবে কী না— এ নিয়ে সংশয় ঘুরপাক খাচ্ছে জোটের নেতাকর্মীদের মধ্যে।
তবে সঙ্কট ও হতাশার কথা স্বীকার করছেন না ২০ দলের নেতারা।
বিএনপি জোটের শরিক জাগপা (জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপর সরকারের জুলুম নির্যাতনের নানা অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনী জনগণের উপর সশস্ত্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সেদিন কিন্তু কোনো নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। পরে জনগণ দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিল। এক-এগারোর সময় দুই নেত্রীকে গ্রেফতারের পরও রাজপথে নেতাকর্মীদের দেখা যায়নি। পরে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। সুতরাং মাঠে না থাকলেই যে আন্দোলন থেমে গেছে এ রকম ভাবা ঠিক না।
তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে বর্তমান সরকার অতীতের যে কোনো স্বৈরাচারী সরকারের চাইতে ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছে। তাই আন্দোলনের গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আন্দোলন নতুন রূপ নিচ্ছে। কিন্তু নেতাকর্মীদের মাঠে না থাকা বা এই নীরবতা প্রচণ্ড ঝড়ের পূর্বলক্ষণ। বর্তমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে এখান থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই।
২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম বীরপ্রতীক ‘চলমান কর্মসূচি থেকে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নাই’ জানিয়ে পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, রাজনৈতিক কর্মীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে ফিরে আসবেই বা কেন?
তিনি বলেন, চলমান আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু এই নয় যে বর্তমান সরকার পদত্যাগ করা মাত্রই ২০ দলীয় জোট ক্ষমতায় আরোহণ করবে। অপরপক্ষে এই আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু হল— এমন একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্মোহ পরিবেশ সৃষ্টি করা যেই পরিবেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সকল আইনগতভাবে উপযুক্ত রাজনৈতিক দল ইচ্ছা করলে উন্মুক্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। বর্তমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সাফল্যের পর যদি জনগণ এ জোটকে পছন্দ করে তাহলে সেই আগামী দিনের ২০ দলীয় সরকার জনগণের হারিয়ে যাওয়া অধিকারগুলো জনগণকে ফেরত দেবে। এইরূপ প্রেক্ষাপটে আমার বক্তব্য, হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
২০ দলের আরেক শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নিবন্ধিত ৪০টির বেশি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৫-৬টির বেশি অংশগ্রহণ করেনি। সরকার আমাদের আন্দোলনে যেতে বাধ্য করেছে। আমাদের চলমান আন্দোলন শান্তিপূর্ণ। পেট্রোলবোমা বা সহিংসতার সঙ্গে ২০ দলের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং মিডিয়ায় দেখছি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাই পেট্রোলবোমাসহ ধরা পড়ছে। এ আন্দোলনে সরকার নেতাকর্মীদের ওপর ‍জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে। এ কারণে তারা একটু হতাশ হতেই পারে। তবে মনোবল ভাঙেনি আমাদের।
তিনি বলেন, সরকার মনে করছে সংলাপ হলে একটা নির্বাচনে যেতেই হবে। আর এ নির্বাচনে তারা বিজয়ী হতে পারবে না। এ জন্য সংলাপে রাজি হচ্ছে না। আর কেন আমরা আন্দোলন থেকে ফিরে আসব। সরকার বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক আচরণ করছে। তাকে মামলা-হামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এই মুহূর্তে তার পক্ষে আন্দোলন থেকে সরে আসার বা কর্মসূচি থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই।
জোটের আরেক শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের দাবি হচ্ছে দেশের গণতন্ত্র রক্ষা, সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত একটি নির্বাচন। শুধু সংলাপ নয়, এর সাথে সরকারকে নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করতে হবে। চলমান আন্দোলন থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। বরং আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হতে পারে।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.)মাহবুবুর রহমান বলেন, নেতাকর্মীরা হতাশ নয়। তাদেরও তো নানা সীমাবদ্ধতা আছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় আন্দোলন থেকে সরে আসার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য অত্যন্ত মহৎ, দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। তা হতে পারে সংলাপের মাধ্যমে। দেশের সুশীল সমাজ জাতিসংঘসহ সমগ্র বিশ্ব বলছে আলোচনার মাধ্যমে চলমান সঙ্কট সমাধানের। আমাদেরও সেই দাবি। সংলাপ বা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। আশা করছি সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। তারা সংলাপের উদ্যোগ নেবে।
এ ব্যাপারে ২০ দলের দ্বিতীয় শরিক জামায়াতের কোনো নেতাকে পাওয়া যায়নি। তবে রবিবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান চলমান অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে সর্বাত্মক সফলের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ২০ দলীয় জোট জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছে। শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলনে ভীত হয়ে সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গণহত্যা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসী-ক্যাডারদের অবৈধভাবে ব্যবহার করে দেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে দেশকে অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, পরিস্থিতি এমন যে এই আন্দোলন আর কতদিন চলবে, আন্দোলনের পরিণতিই বা কি হবে সে বিষয়ে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।
গত ৫ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের প্রথম বছরপূর্তির দিনটিকে ‘গণতন্ত্রের কালো দিবস’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং একই দিন ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার দিবস’ ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট ঢাকায় সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। এ অবস্থায় ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ডিএমপি (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ)। দুই রাজনৈতিক জোটের রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি এমন কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা দেন। এর দুই দিন আগে ৩ জানুয়ারি থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এক ধরনের অবরুদ্ধ অবস্থায় গুলশান কার্যালয়ে ছিলেন খালেদা জিয়া। এরপর গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে বালু, ইট ও পাথরের ট্রাক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও গত ৫৭ দিন ধরে কার্যালয়েই অবস্থান করছেন খালেদা। রবিবার অবরোধ কর্মসূচির ৫৪ দিন কেটে গেল। পাশাপাশি চলছে হরতাল কর্মসূচি।
অবরোধ কর্মসূচির প্রথমদিকে ঢাকাসহ সারাদেশে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের অনেককে মাঠে দেখা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা দেখা যাচ্ছে না।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend