প্রশাসনের যে ভূমিকা রাখা উচিত- আলী ইমাম মজুমদার

প্রশাসনের কর্মকর্তারা দলীয় লোকের মতো আচরণ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা
প্রশাসনের কর্মকর্তারা দলীয় লোকের মতো আচরণ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা

সংকট প্রত্যেক জাতির জীবনে সময়ে সময়ে আসতে পারে। তা মোকাবিলাও করতে হয়। সংকটের আকৃতি ও প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য রাষ্ট্রের অন্যায্য আচরণের জন্যও কোথাও সংকটের সৃষ্টি হয়। আর আমাদের বেশ কিছু সংকট কিন্তু আমরা নিজেরাই ডেকে আনি। প্রায় ক্ষেত্রে রাজনীতির নামে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে। আর সেই ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে’ সময়ে সময়ে অধিকারবঞ্চিত করা হয় সেই মানুষকেই।
বর্তমান সংকটটিও এ-জাতীয়। সংবিধান স্বীকৃত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা আর চলাফেরার স্বাধীনতা আজ হরতাল-অবরোধের নামে হুমকির মুখে। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধ যারা করছে, তাদের সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতাও অপর পক্ষ কর্তৃক কার্যত অস্বীকৃত। মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয়ে ভোগান্তির শিকার গোটা দেশবাসী। অবশ্য এটা আমাদের জন্য অভিনব কিছু নয়। রকমফের ঘটলেও ক্ষমতার পক্ষ-বিপক্ষ দল এরূপই করে চলছে গত কয়েক দশক। সবগুলোরই কোনো না কোনোভাবে ইতি ঘটেছে। এবারও নিশ্চয়ই তা ঘটবে। তবে কখন আর কীভাবে, এ প্রশ্নের প্রকৃত জবাব একেকজন একেকভাবে দিচ্ছেন।
রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এ-জাতীয় সময়ে অধিক তৎপর থাকতে হয়। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যারা আছে, তাদের সামনে দেখা দেয় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। সংকটটি রাজনীতিসৃষ্ট হলেও আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থায় প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে। সুতরাং জনগণের যানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা রয়েছে, তাদের অধিকতর তৎপর হতে হয়। রাষ্ট্রের আইন এ দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করেছে। তা যথার্থভাবে পালন করা তাদের কর্তব্য। দাবি যেটাই হোক, গাড়িতে পেট্রলবোমা মেরে কিংবা অন্য কোনোভাবে কেউ কাউকে হতাহত করতে পারে না। সৃষ্টি করতে পারে না চলার পথে বিঘ্ন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তব্যরত সদস্যদের ওপর হামলা চালাতে পারে না। পারে না রেললাইন উপড়ে ফেলে দুর্ঘটনার কারণ ঘটাতে। এমনকি পারে না জলযানে আগুন দিতে।
যে বা যারা এগুলো করে, তাদের যথাযথভাবে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা প্রশাসনের দায়িত্ব। আশঙ্কা করা অযৌক্তিক হবে না যে বর্তমান প্রশাসনব্যবস্থাকে যেভাবে দলমুখী করা হয়েছে, এতে প্রকৃত দোষী ব্যক্তির পাশাপাশি কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাদ দিয়ে শুধু বিরোধী দল করে বলেই কিছু লোককে মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। অভিযোগ রয়েছে, তা হচ্ছেও। এসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে শত শত ব্যক্তির নামে। সৃষ্টি হচ্ছে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের সুযোগ। এতে প্রকৃত উদ্দেশ্য হবে ব্যাহত। জনগণের যানমালের ক্ষয়ক্ষতি যারা করে চলেছে, তারা অনেক ক্ষেত্রে থাকবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ যেকোনো অবস্থায় এ-জাতীয় অপরাধীদের ক্ষমাহীন দৃষ্টিতে দেখা যৌক্তিক ও সংগত। আর তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রশাসনের।
এরপর থাকছে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, সংকটের উৎস রাজনীতি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার মন্তব্য রাখা অসংগত হবে। আচরণবিধি অনুসারে তা করার সুযোগ তাদের নেই। তবে তারা বলতে পারে, যেকোনো অবস্থায় জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যে বা যারা ঘটাবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। শুধু বলা নয়, দৃশ্যমান ও পক্ষপাতহীনভাবে তা করতেও হবে। হরতাল–অবরোধ আহ্বান করার অধিকার কোনো দলের যেমন রয়েছে, অন্যদের রয়েছে তা মানা না-মানার অধিকার। অথচ এসব কর্মসূচির শুরুতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে জনজীবনকে অচল করে দেওয়া হয়। অতীতেও তা হয়েছে। তবে যেকোনো এক স্থানে এসে বিষয়টির ইতি ঘটা প্রয়োজন। চলাচলের স্বাধীনতায় বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগকারীদেরও একইভাবে আনতে হবে আইনের আওতায়।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা রয়েছে। তবে ব্যবস্থাটি ভেজাল বন্ধ, বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং রোধসহ অনেক অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে জনগণের প্রশংসা অর্জন করেছে। আবার অপরাধ তাঁদের সামনে সংঘটিত হয়নি কিংবা অভিযুক্ত স্বীকার করেনি দোষ, এমন ক্ষেত্রেও সাজা দেওয়ার কথা জানা যায়। এটা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভাবা অসংগত হবে না, এরূপ ঘটছে প্রশাসনে দলীয় প্রভাব আর কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তার কারণে। স্থানীয় কর্মকর্তারা যদি জনগণের কাছে নিজদের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সক্ষম হন, তখন তাঁদের অনেকেই প্রশাসনের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন। নাশকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে মিলবে প্রকৃত তথ্য। যে তথ্যের ভিত্তিতে অগ্রসর হলে মূল অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সহজ হবে। শত শত লোক অকারণ হয়রানির হাত থেকে বেঁচে যাবে।
পাশাপাশি একপর্যায়ে নাশকতাকারীরাও গুটিয়ে নেবে তাদের হাত। তা না করে প্রশাসনের কর্মকর্তারা দলীয় লোকের মতো আচরণ করলে তাঁদের ক্রমহ্রাসমান সক্ষমতা ও মর্যাদায় ভাটার টান আরও জোরদার হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক সত্তা। রাজনীতি একে পরিচালিত করে। পরিচালনার মূল দায়িত্বেও থাকেন রাজনীতিকেরা। তবে তাঁদের সহযোগী হিসেবে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রশাসন কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তা করতে গিয়ে তাঁরা নিজদের মৌলিক চরিত্র বর্জন করতে পারেন না। সংবিধানের ভাষ্য অনুসারে তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কোনো দল বা ব্যক্তির নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত
আজ কাঙ্ক্ষিত চিত্রটি প্রায় অনুপস্থিত। আর ক্ষমতার পালাবদল হলেও অবস্থা থাকে অপরিবর্তিত।
আন্দোলন বা রাজনৈতিক কর্মসূচির আড়ালে জোরজবরদস্তি আর নাশকতামূলক কাজ অপরাধ। নাশকতায় হতাহতের ঘটনা ঘটে আর জোরজবরদস্তি করে চলাফেরা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এ প্রবণতা অগ্রহণযোগ্য। সংবিধান প্রদত্ত জনগণের এই অধিকার কেউ তাদের কর্মসূচির নামে হরণ করে নিতে পারে না। ঠিক তেমনি কোনো বৈধ রাজনৈতিক দলের আইনসম্মত সমাবেশ করার অধিকারও আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ ছাড়া কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
নির্দ্বিধায় বলা চলে, ৬ জানুয়ারি থেকে চলমান অবরোধ ও সময়ে সময়ে হরতাল জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রাণ হারিয়েছে অনেকেই। আহত শত শত। অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি বেশুমার। তবে এটুকু বলা যৌক্তিক যে কার্যত অবরোধ শুরু ৪ জানুয়ারি থেকে। উদ্দেশ্য, ৫ জানুয়ারি বিরোধী দল কর্তৃক ঢাকায় আহূত একটি সমাবেশ ঠেকানো। শুধু তা-ই নয়, দলের প্রধানকে বেশ কয়েক দিন অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। সেই সমাবেশটি হলেই কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত? তা হতে না দিয়ে কি সুফল মিলেছে? তবে আপামর জনগণ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চায় না। তারা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের পক্ষে। যাত্রী ও মালামাল চলাচলের সুবিধার্থে অনেক গাড়ির বহর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় বিভিন্ন স্থানে চলাচল করছে। উদ্যোগটি সাধু। তবে এটা কোনো স্থায়ী পদ্ধতি হতে পারে না। আর এ কাফেলায়ও আক্রমণের ঘটনা ঘটছে।
পত্রপত্রিকার হিসাব অনুসারে দূরপাল্লার বাস, ট্রাক চলাচল ২০ থেকে ৩০ শতাংশে সীমিত আছে। এ অবস্থায় এটুকু করা যাচ্ছে, এটাই প্রশংসনীয়। ৫ জানুয়ারি ঢাকায় একটি দলকে সভা করতে দিলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকত, এমন দাবিও কেউ করে না। তবে দেওয়া উচিত ছিল, এমনটাই অনেকে মনে করেন। এর অপব্যবহার তারা করলে আইনি ব্যবস্থা তো ছিলই। এসব সিদ্ধান্ত যারা নিল, তাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরামর্শ দেওয়া উচিত ছিল, এটা ভালো ফল দেবে না। মনে করার সংগত কারণ আছে যে তা না করে উল্টোটাই করেছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। তবে অতীতের যত মন্দ নজিরই থাকুক, সরকারবিরোধীরা হরতাল, অবরোধের নামে একটি জাতিকে দিনের পর দিন জিম্মি করে রাখতে পারে না। এর বিকল্প কর্মসূচির কথা তাদের ভাবতে হবে।
পরিশেষে আবার আসে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রসঙ্গটি। জনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে তাঁদের ‘পরশুরামের কঠোর কুঠার’ পক্ষপাতহীনভাবে ব্যবহার করতে হবে। তবে রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো মন্তব্য তাঁরা করবেন না। রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার বিষয়টি নিষ্পত্তির এখতিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend