দেশ-বিদেশের চাপে সরকার

govtবাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে বিশ্ব। সমালোচনার ঝড় তুলেছে বাংলাদেশের সুশীল সমাজও। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় দেশী-বেদেশী চাপের মুখে সরকার। যুক্তরাজ্য, মানবাধিকার ও আর্থিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের প্রাত্যহিক জীবনেও আতঙ্ক আর ভয় বিরাজ করছে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকার দেশী-বিদেশী সমালোচনা আমলে নিচ্ছে না। সামনের দিনগুলোতে সরকার আরও কঠিন হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ভিন্নমত বা অন্যমতকে কঠোর হাতে দমন করবে সরকার। প্রয়োজনে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করতেও পিছু হটবে না সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সরকার ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন আভাস দিয়েছেন।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড এ্যডামস শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের শক্তির অপপ্রয়োগ, বিরোধী দল দমনে গ্রেফতার, গণমাধ্যমের ওপর অবৈধ নিয়ন্ত্রণারোপ ও সেন্সরশিপ, জনগণের মতকে দমনের বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। অনাকাঙ্ক্ষিত এ সব ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না।’ আর্থিক খাত ও অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক ফিমালাক এস এ এবং নিউইয়র্ক ভিত্তিক হার্টস করপোরেশনের যৌথ মালিকানায় পরিচালিত শতবর্ষের পুরানো আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ফিচ রেটিং’ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থায় শুক্রবার সকালে (ঢাকার স্থানীয় সময়) উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ফিচ রেটিং’ বলছে, ‘জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে সংঘটিত কর্মকাণ্ড দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদেশী বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রভাবিত হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রা অর্জনের অন্যতম তৈরী পোষাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
সংস্থাটি আরও বলছে, ‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা আগের বছরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে। ওই বছর রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩০০ জনের বেশী মানুষ প্রাণ হারায়। ২০১৫ সালে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা খুবই উদ্বেগের। কেননা এতে বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগ হারাবে, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের উচিত, দেশের স্বার্থে, ইতিবাচক অর্থনীতির স্বার্থে সহিংসতা বন্ধ করা এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসন করা।’
ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন, মর্মাহত, ব্যথিত ও চিন্তিত। চলমান ঘটনা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উচিত অনতিবিলম্বে নিজেদের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা।’
কূটনীতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ৫ জানুয়ারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের কার্যালয়ে ইউরোপ ও উন্নত বিশ্বের কূটনীতিকরা ৫ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন। তারা বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা ঘটনায় হতাশ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়ারও চিন্তা করেছে।
এ বিষয়ে দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির মুখপাত্র জানান, বৈঠকগুলো তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ।
বাংলাদেশের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে টিআইবি’র (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে যা ঘটছে তা শুভকর নয়। এমন অবস্থার ফাঁকে অশুভ শক্তি ফাঁদ পেতে থাকে। যা কারোর জন্যই মঙ্গলজনক নয়। সমাধানের চাবিকাঠি প্রধান দুই নেতার হাতে। ব্যক্তিগত আক্রোশ বাদ দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দুই নেতাকেই পথ বের করতে হবে। তাদের এক টেবিলে বসতে হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা তিনি সরকারে আছেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতা প্রদর্শনের চক্র থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে জনজীবনে কখনোই স্থিতিশীলতা আসবে না। এ চক্র ভাঙতে হলে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের এগিয়ে আসতে হবে। তা যে প্রক্রিয়ার মধ্যেই হোক না কেন। আবার ক্ষমতার বাইরে থাকা নেতাকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তা না হলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকবে। যা সামাল দিতে পারা সহজ হবে না।
বাংলাদেশের সিনিয়র এক কূটনীতিক, বঙ্গবন্ধুভক্ত ও সাবেক সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফ্রিকা ও সিঙ্গাপুরের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কখন কি ঘটবে তা কেউ বলতে পারে না। এগুলো আমাদের রাজনীতিকরাও জানেন। এরপরেও তারা ডেকে ডেকে অশুভ শক্তিকে আমন্ত্রণ জানান। যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য মোটেই ইতিবাচক নয়।’
(সূত্র: দ্য রিপোর্ট)

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend