মডেলিং থেকে যারা আসে তারা অভিনয়ই জানে না

 চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তানভীর মোকাম্মেলকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সচেতন মানুষের কাছে তিনি প্রাণপুরুষ। যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যে নিজ থেকেই তাগিদ অনুভব করেন। যিনি হাজার বছরের বাঙ্গালীর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অসংখ্যবার। তার চলচ্চিত্র সবসময়ই নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার কথা বলে, অশ্রু সিক্ত নারীর ভেজা চোখের কথা বলে। এজন্যেই তিনি নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল।

সম্প্রতি তিনি নির্মাণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘জীবনঢুলী’। চলচ্চিত্রটি সাধারণ দর্শকদের মাঝে ব্যাপক কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে। তাই বাংলামেইলের পাঠকদের জন্যে গুণী এই নির্মাতার চলচ্চিত্র দর্শন ও ভাবনার কথা নিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলামেইলের নিউজরুম এডিটর মনোজিৎ মিত্র।

খবর বাংলা২৪: আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল প্রেরণা কী কিংবা কেনই বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন?
তানভীর মোকাম্মেল: দুই ধরণের চলচ্চিত্রনির্মাতা রয়েছেন। এক ধরনের যারা অর্থ বা অন্য কোনো প্রাপ্তির জন্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে থাকেন। আরেক ধরনের চলচ্চিত্রনির্মাতা আছেন যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন কারণ তারা ভেতর থেকে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করেন। নিজেকে যতটা বুঝতে পারি, আমি দ্বিতীয় ঘরানার চলচ্চিত্রনির্মাতা।
ছবি: শুটিং চলাকালীন সময়ে ব্যস্ত তানভীর মোকাম্মেল

যে সব রাজনৈতিক কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনা বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে সেসব বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ব্যাপারটি আমাকে অনুপ্রাণিত করে। যেমন সাতচল্লিশের দেশভাগ, যা লক্ষ লক্ষ পরিবারের জীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল, তা নিয়ে আমার চলচ্চিত্র আছে ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’। কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, যে মহাকাব্যিক ঘটনাটি কোটি কোটি মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল, তা নিয়ে আমার বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র রয়েছে ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘রাবেয়া’, ‘জীবনঢুলী’। তাছাড়া আমি অনেক সময় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে অনুপ্রাণিত বোধ করি। বিশেষ করে সেই সব বিষয় নিয়ে যেখানে মানুষের বঞ্চনা আছে, নীরব অশ্রু আছে। যেমন বাংলাদেশের গার্মেন্টসের মেয়েদের দুঃখ-দূর্দশা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘বস্ত্রবালিকারা’, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাগুলোর দুঃখ-বঞ্চনার ঘটনা নিয়ে ‘কর্ণফুলীর কান্না’ বা জেনেভা ক্যাম্পে বসবাসকারি উর্দূভাষী মুসলমান বা বিহারীদের দূর্ভোগ ও যন্ত্রণা নিয়ে ‘স্বপ্নভূমি’। আমি মনে করি একজন শিল্পী হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে যেখানে বঞ্চনা আছে, নীরব অশ্রু আছে, তা তুলে ধরা। ভাষাহীনের কণ্ঠে ভাষা যোগানো। কোনো কোনো বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে আমি কাহিনীচলচ্চিত্র বানাতেই বেশি প্রেরণা অনুভব করি, আবার কোনো কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রামাণ্যচিত্র তৈরীর আগ্রহ বোধ করি। ব্যাপারটা বিষয়বস্তু অনুযায়ী হয়।

 খবর বাংলা২৪: ইংরেজী সাহিত্য থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে আসার সময়কার গল্পটা….?
তানভীর মোকাম্মেল: বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন করতাম। দেশ-বিদেশের ধ্রুপদী চলচ্চিত্র দেখানো, সেমিনার-ওয়ার্কশপের আয়োজন করা, চলচ্চিত্র নিয়ে মননশীল লেখালিখি, পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদি করতাম। এক সময় মনে হলো, নিজে হাতেকলমে চলচ্চিত্র তৈরী করলে তা বেশি আনন্দদায়ক হবে। তখন ১৯৮১ সাল, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে একটা ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স হয়। আমি সে কোর্সের ছাত্র ছিলাম। সেখানে আমাদেরকে কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতাটির চিত্রনাট্য লিখতে দেওয়া হয়। চিত্রনাট্যটি লেখার সময় আমার মনে হয়েছিলো যে কবিতাটির চিত্রকল্পগুলো এত জীবন্ত যে তা থেকে একটা ভালো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সম্ভাবনা রয়েছে। তখন আমি ‘হুলিয়া’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করি। চলচ্চিত্রটার অনেক কারিগরী ত্রুটি থাকলেও ছবিটা জনগণ বেশ পছন্দ করেছিল। তারপর আমি ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘অচিন পাখি’, ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ এরকম একটার পর একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে শুরু করি।
খবর বাংলা২৪চলচ্চিত্রের জন্য কেন সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেন?
তানভীর মোকাম্মেল: আগেই বলেছি যে বড় কোনো রাজনৈতিক ওলটপালটের ঘটনা, যা লক্ষ লক্ষ পরিবার ও মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে তা আমাকে আকর্ষণ করে। যেমন ১৯৪৭ এর বাংলা ভাগ বা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ।
 মুক্তিযুদ্ধের কথাটাই ধরা যাক। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে এত বড় সশস্ত্র রাজনৈতিক ঘটনা তো আর ঘটেনি। তিরিশ লক্ষ মানুষ মারা গেলো, দুই লক্ষের বেশি নারী লাঞ্চিত হলো, প্রায় এক কোটি শরণার্থী জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল। ১৯৭১ সালে সব কিছুই ঘটেছে এক মহাকাব্যিক স্তরে ও সংখ্যায়। এখন এই বিশাল চালচিত্রটা আমাকে আকর্ষণ করে। এই মহাকাব্যিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে আমি আমার চরিত্রদের প্রতিস্থাপন করার একটা সুযোগ পাই। যুদ্ধ, মৃত্যু ও ধ্বংসের মাঝে এসব চরিত্রদের কোনো না কোনো নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যে সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত মানবতার পক্ষে যায়। যেমন ‘নদীর নাম মধুমতি’ চলচ্চিত্রে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু তার রাজাকার চাচাকে (যাকে সে নিজের বাবা বলেই মনে করত) হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়; ‘রাবেয়া’ চলচ্চিত্রে রাবেয়া বোনটি নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের মৃতদেহটি কবর দিতে এগিয়ে আসে; ‘জীবনঢুলী’তে জীবনঢুলী আগুনের মাঝে দাঁড়িয়েও তার প্রতিবাদের ঢাক বাজায়। আর ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ চলচ্চিত্রে দেশভাগের সর্বগ্রাসী ভাঙ্গন ও ব্যাপক দেশত্যাগের মাঝেও উকিল শশীকান্ত জন্মভূমি ছেড়ে না যাবার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মানুষের এই নৈতিক ও মানবিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাটা আমাকে খুবই আকর্ষণ করে। আর সে ধরণের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় কেবল বড় কোনো রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিপর্যয়কারি ঘটনার সময়েই। সে কারণেই এ বিষয়গুলো আমাকে আকর্ষণ করে।
ছবি: তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘জীবনঢুলী’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
খবর বাংলা২৪: স্বাধীনতা যুদ্ধে গণহত্যার প্রেক্ষাপটে নির্মিত ‘জীবনঢুলী’র জীবনভাবনা ?
তানভীর মোকাম্মেল: ‘জীবনঢুলী’ ঠিক গণহত্যা বিষয়ক চলচ্চিত্র নয়, এটা ১৯৭১ সালে একটা পরিবারের অভিজ্ঞতার কাহিনী। তবে চলচ্চিত্রটিতে দুটি গণহত্যা দেখানো হয়েছে। প্রথমত, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী জীবনঢুলীদের গ্রাম পরাণপুরে আক্রমণ চালায় এবং বহু মানুষকে হত্যা করে। আর দ্বিতীয় যে গণহত্যাটি দেখানো হয় সেটা চুকনগর গণহত্যা, যা একটি সত্যি ঘটনা। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার চুকনগরে ১৯৭১ সালের ২০ মে তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। যেখানে মাত্র এক সকালে সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। যাদেরকে হত্যা করা হয় তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, তরুণও ছিল না। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদেরকে পাখির মতো গুলি করে করে হত্যা করা হয়েছিল। এ ছিল যথার্থই এক গণহত্যা। যেহেতু জীবনঢুলীর নিজের পরিবার এই চুকনগর গণহত্যায় নিহত হয়েছিল তাই ‘জীবনঢুলী’ চলচ্চিত্রে আমরা এই গণহত্যার দৃশ্যটি পুনঃসৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি এবং চলচ্চিত্রটির বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে এই গণহত্যার চিত্রায়ন রয়েছে।
খবর বাংলা২৪: ‘জীবনঢুলী’ নিয়ে দর্শকদের কী রকম সাড়া পেয়েছেন ?
তানভীর মোকাম্মেল: খুবই ভালো। প্রচুর দর্শক চলচ্চিত্রটা দেখতে আসছেন এবং আমরা নানারকম ইতিবাচক মন্তব্য পাচ্ছি। চলচ্চিত্রটা নিয়ে তরুণদের মধ্যেও বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করছি। ফেসবুকে ও ইন্টারনেটে এটা নিয়ে তরুণদের নানা লেখালিখি ও মন্তব্য আমার চোখে পড়ছে। দেশের বাইরে এ পর্যন্ত ভারতের কলকাতা, জয়পুর ও শিলিগুড়িতে ‘জীবনঢুলী’ দেখানো হয়েছে এবং সব জায়গা থেকেই চলচ্চিত্রটার ব্যাপারে দর্শকদের অত্যন্ত ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।
খবর বাংলা২৪দেশ বিভাগ নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’, এখন এই সময়ের সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা আছে কী?
তানভীর মোকাম্মেল: সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে একটা মফস্বল শহরের একটি মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের জীবনে কী বিপর্যয় নেমে এসেছিল সেটা ছিল ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ চলচ্চিত্রটার বিষয়বস্তু। দুঃখজনক যে একটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এতো বছর পরে, আজও এই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নানারকম নিপীড়ন-নির্যাতন ঘটে চলেছে। এই মুহুর্তে কেবল সাম্প্রদায়িকতা নিয়েই কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা আমার নেই, তবে আমার সব চলচ্চিত্রেই সাম্প্রদায়িকার বিরুদ্ধে বক্তব্য আছে।যেমন আছে ‘জীবনঢুলী’ এবং প্রামাণ্যচিত্র ‘১৯৭১’ এ। তাছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি যেমন গবেষণাধর্মী একটি বড় চলচ্চিত্র ‘১৯৭১’ বানিয়েছি, তেমনি সাতচল্লিশের দেশভাগ নিয়েও সেরকম একটি গবেষণাধর্মী বড় প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করার পরিকল্পনা রয়েছে।যা অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী হবে।
খবর বাংলা২৪: এখন পর্যন্ত নির্মিত নিজের কোন চলচ্চিত্রটিকে সেরা ভাবেন?
তানভীর মোকাম্মেল: এ বড় কঠিন প্রশ্ন। আপনি যেমন কোনো মাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না যে তার অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে কে তার সবচেয়ে প্রিয়, তেমনি একজন চলচ্চিত্রকারের ক্ষেত্রেও সেটা খাটে! একেকটা চলচ্চিত্র একেক কারণে আমার কাছে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ। ‘নদীর নাম মধুমতী’ চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যটি খুব ভালো ছিল, কিন্তু সেনাবাহিনীর সহায়তার অভাবে অ্যাকশন-দৃশ্যগুলো ভালো হয়নি, যেটা আবার বেশ ভালো হয়েছে ‘জীবনঢুলী’তে। ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ চলচ্চিত্রে এদেশের হিন্দু পরিবারগুলোর দুঃখ-দূর্দশা তুলে ধরার ব্যাপারে একটা গভীর আবেগ আমার মনে কাজ করেছিল; ‘লালসালু’র কাহিনী ও চরিত্রগুলো অসাধারণ, আবার ‘লালন’ এর দর্শনের কারণে এবং বিশেষ করে, ছত্রিশজন বাউল ও বাউল-সঙ্গিনীরা যেভাবে চলচ্চিত্রটাতে অভিনয় করেছে তাতে ‘লালন’ চলচ্চিত্রও আমার বেশ প্রিয়।
ছবি: তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

তাছাড়া আমার বেশ ক’টি প্রামাণ্যচিত্র আমার খুব পছন্দের। যেমন মেগা প্রামাণ্যচিত্র ‘১৯৭১’, পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর সমস্যা নিয়ে ‘কর্ণফুলির কান্না’, যমনুা নদী নিয়ে ‘অয়ি যমুনা’, গার্মেন্টসের মেয়েদের নিয়ে ‘বস্ত্রবালিকারা’ অথবা সুন্দরবনের তীর্থযাত্রীদের নিয়ে ‘বনযাত্রী’। আসলে প্রতিটা চলচ্চিত্র নিয়েই সুখ-দুঃখের অনেক জীবন্ত স্মৃতি জড়িয়ে থাকে বলে আমার প্রতিটা চলচ্চিত্রের ব্যাপারেই আমি কিছুটা আবেগ অনুভব করি। তবে সেরা ছবি? সেটা দর্শকরাই হয়তো বলতে পারবেন। আমার পক্ষে বলা কঠিন।

খবর বাংলা২৪: উপন্যাস থেকে ‘লালসালু’ নির্মাণ করলেন, আর কারও উপন্যাস নিয়ে ছবি বানানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কী ? কোন কোন উপন্যাস পড়ে আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছে করেছে?

তানভীর মোকাম্মেল: আমি একটা বই লিখেছিলাম। সাহিত্য সমালোচনার বই ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সিসিফাস ও উপন্যাসে ঐতিহ্যজিজ্ঞাসা’। বইটা লিখতে গিয়ে ‘লালসালু’ উপন্যাসটি আমাকে বারবার পড়তে হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল উপন্যাসটি খুবই চলচ্চিত্রিক এবং তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে ‘লালসালু’ নিয়ে আমি একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করব।

আর কোনো উপন্যাস পড়ে তেমনটি মনে হয়নি। আসলে চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে এতো ধারণা ও দৃশ্য আমার মনে এমনিতেই সারাক্ষণ সৃষ্টি হয়, যেমন ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’, ‘লালন’, ‘জীবনঢুলী’ এসবই আমার কাহিনী, যে অন্যের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের তেমন কোনো তাগিদ বোধ করি না। এখনও আমার মনে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু ঘুরছে, যার সবই আমার একান্ত নিজস্ব চিন্তা ও মৌলিক কিছু।
ছবি: নিজ বাসায় নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল
খবর বাংলা২৪আমাদের চলচ্চিত্রের বর্তমান সামগ্রিক অবস্থা বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
তানভীর মোকাম্মেল: দীর্ঘদিন ধরেই তো বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের খুবই দূরবস্থা। কী বিষয়বস্তুতে, কী প্রযুক্তিতে, আন্তর্জাতিক মানে তো বটেই, এই উপমহাদেশের মানেও প্রায় তিরিশ বছর পিছিয়ে রয়েছে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র । সাম্প্রতিককালে ভালো কাজ যেটুকু যা হয়েছে তা হয়েছে বাংলাদেশের বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। তারেক মাসুদকে হারিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। আশা করি এই ধারায় আরো অনেক নতুন চলচ্চিত্রকার আসবেন যারা মেধাবী ও সৃজনশীল। ডিজিটাল প্রযুক্তি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সামনেও বর্তমানে এক ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।
খবর বাংলা২৪: বাংলা চলচ্চিত্রে এই মুহুর্তে অনেক নতুন মুখ আসছে, কিন্তু তাদের অভিনয় কেন একই আঙ্গিকের ?
তানভীর মোকাম্মেল: আসলে আমাদের দেশে তো বিদেশের মতো অভিনয় শেখানোর তেমন কোনো ইনস্টিটিউট নেই। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যে যার মতো অভিনয় করে। নতুন যারা আসে তারা পুরনোদের দেখে শেখে বা তাদের অনুকরণ করে। ফলে অভিনয়শিল্পে নতুন কিছু তারা যোগ করতে পারে না। মূলত, শিক্ষার অভাবই এর কারণ। আর মডেলিং থেকে যারা আসে তারা অভিনয়ই জানে না। কেবল যারা মঞ্চ-নাটক থেকে চলচ্চিত্রে আসেন তারা বিভিন্ন রকমের অভিনয়রীতি সম্পর্কে কিছু ধারণা নিয়ে আসেন এবং তাদের কাজই ভালো হয়ে থাকে।
খবর বাংলা২৪: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে আপনি কোনটিকে চিহ্নিত করবেন ?
তানভীর মোকাম্মেল: আমি মনে করি, সবচে বড় সমস্যা চলচ্চিত্র-শিক্ষার অভাব। আমাদের দেশে যারা চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাদের অনেকেরই শিক্ষা, মেধা, মনন, এমনকি চলচ্চিত্রবোধেরও অভাব রয়েছে। দেশেবিদেশের ধ্রুপদী ও আধুনিক চলচ্চিত্রের ধারা-উপধারা সম্পর্কে তাদের সামান্যই ধারণা রয়েছে। যতদিন শিক্ষার এই দৈন্য না কাটবে ততদিন এদেশে ধারাবাহিকভাবে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়া কঠিন হবে। আপনি ‘স্বভাবকবি’ হতে পারেন, কিন্তু ‘স্বভাবচলচ্চিত্রকার’ হতে পারবেন না। চলচ্চিত্র একটা আধুনিক প্রযুক্তিগত মাধ্যম। সেই প্রযুক্তিটা তো শিখতে হবে। দেশে তাই ভালো ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরি হওয়া জরুরি, যেখান থেকে সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা, সাউন্ড-রেকর্ডিং, শিল্প-নিদের্শনা ও অভিনয়, এসব বিষয়ে প্রশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে আসবে। কেবলই তখনই বাংলাদেশে বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হবে
WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend