সিটি নির্বাচন > ৩ প্রধান দৈনিকের খবর >>> জিতল আ.লীগ, হারল গণতন্ত্র (প্রথম আলো), বেপরোয়া জালিয়াতি (সমকাল),ডিজিটাল জমানায় এনালগ কারচুপি (মানবজমিন)

44_78461বিশেষ প্রতিনিধি:তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঘিরে মানুষের মধ্যে যে শঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই সত্যি হলো। প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হলেও গণতন্ত্রের পরাজয় হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় তোলা এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের খেলায় গণতন্ত্র হেরেছে। সরকার-সমর্থকেরা বিরোধীদের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রের কাছেই যেতে দেননি। অনেকটা ফাঁকা মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় উন্মুক্ত কারচুপি করেছেন তাঁরা। আর বিরোধী দল বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীরা ভোট শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামে মনজুর আলম বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার ঘণ্টা খানেক পরই ঢাকায় একই ঘোষণা দেন মির্জা আব্বাসের পক্ষে তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাস এবং তাবিথ আউয়াল।

প্রথম আলোর ২৭ জন প্রতিবেদক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ হাজার ৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২৩টি ও ঢাকা দক্ষিণের ৮৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫৬টি কেন্দ্র ঘুরে এই চিত্র পেয়েছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৭১৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২৭টি কেন্দ্র ঘুরেছেন প্রথম আলোর ১২ জন প্রতিবেদক। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাকি কেন্দ্রগুলোতে কোথাও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, কোথাও সামান্য বা বড় কারচুপি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ, দক্ষিণে ১৮ লাখ ৭০ হাজার এবং চট্টগ্রামে ১৮ লাখ ১৩ হাজার ভোটার ছিলেন। এর মধ্যে কত শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন, সে তথ্য নির্বাচন কমিশন আজ বুধবার জানাবে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনটি সিটি করপোরেশনেই এগিয়ে আছেন সরকার-সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা। তাঁরা হলেন ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন এবং চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির উদ্দিন। তিন সিটি করপোরেশনে এগিয়ে থাকা কাউন্সিলর প্রার্থীদের বেশির ভাগই সরকারি দল-সমর্থক।

এ পরিস্থিতির মধ্যেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ দাবি করেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। ব্যাপক ভোটার উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে কোনো সমস্যা হওয়া বা ভোটকেন্দ্রে যেতে ভয়ভীতি দেখানোর কথা তাঁকে বলেননি।

৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর গতকালের এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে শঙ্কাই সত্য হয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। পরাজয়ের আশঙ্কায় বিএনপি ভোট বর্জন করেছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বিএনপি কিংবা তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা গতকালের পরিস্থিতি প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা, কোনো প্রতিবাদও করেননি। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থক ও পুলিশের উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ডে তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। এ কারণে বেশির ভাগ কেন্দ্রেই বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীদের এজেন্ট ছিলেন না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে দলটির তিন মেয়র প্রার্থী মাঝপথে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। এর আগে আন্দোলনের মাঠ থেকে সম্পূর্ণ অগোছালো অবস্থায় নির্বাচনের মাঠে এসে দলটি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে ফাঁকা মাঠে সরকার-সমর্থক ও দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা কারচুপির প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেকগুলো কেন্দ্রে নিজেদের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করেন। ঢাকা দক্ষিণে কবি নজরুল কলেজ কেন্দ্রে এমনই এক সংঘর্ষের মধ্যে আটকে পড়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত। পরে বিজিবি গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর রাষ্ট্রদূত সেখান থেকে বের হন।

এ ছাড়া একাধিক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকা উত্তরে কাফরুল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদা আক্তার ও বিদ্রোহী প্রার্থী মতি মোল্লার সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুরান ঢাকায় বাংলাদেশ ললিতকলা একাডেমি কেন্দ্রে ভোটারদের ওপর এক সাংসদের গানম্যানের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।

এসব ঘটনার তথ্য ও চিত্র সংগ্রহ করতে গণমাধ্যমকর্মীদের বাধা দিয়েছেন সরকারি দল-সমর্থক কিছু কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোনো কোনো কেন্দ্রে তাঁদের মারধর করা হয়েছে।

গতকাল চট্টগ্রামে কয়েকটি কেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। ঢাকায় তিনটি কেন্দ্রে নির্বাচন বাতিল করা হয়। এগুলো হচ্ছে সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়, শেরেবাংলা উচ্চবিদ্যালয়, কমলাপুর এবং আশরাফ মাস্টার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। চট্টগ্রামের একাধিক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সাময়িক স্থগিত রেখে পরে চালু করা হয়।

ভোট গ্রহণের মাঝখানে নির্বাচন বর্জন করেন বিরোধী দল-সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা। বেলা সোয়া ১১টায় চট্টগ্রামের বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। দলীয় নেতাদের উপস্থিতিতে এ সময় তিনি রাজনীতি থেকে অবসরের কথাও জানান দেন।

দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকায় বিএনপি-সমর্থিত দুই মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস ও তাবিথ আউয়ালের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।

জবরদস্তি ও কারচুপির পর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে এই নির্বাচন আক্ষরিক অর্থেই একতরফা হয়ে পড়ে। তার পরও সরকার-সমর্থকেরা বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরেন। এ পর্যায়ে কাউন্সিলর প্রার্থীরা বেশি তৎপর ছিলেন।

সরকারি দলের কৌশল: আগের রাতেই প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের আশপাশে সরকারি দল তাদের সমর্থিত প্রার্থীর পোস্টার ঝুলিয়ে ও বসার জায়গা সাজিয়ে দখল করে। রাতে অনেক কর্মী সেখানেই অবস্থান করেন। সকাল থেকে তাঁরা তৎপরতা শুরু করেন।

এ অবস্থায় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রের আশপাশে যাওয়া কিংবা অবস্থান করার সুযোগই পাননি। এর পরও যাঁরা সেখানে যাওয়ার ও ভোটকেন্দ্রে অবস্থানের চেষ্টা করেছেন, তাঁরা হামলার শিকার হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে যাঁদের বুথগুলোতে থাকার কথা ছিল, তাঁদের প্রায় সবাইকেই আগেভাগে এই দায়িত্ব পালন করতে না যাওয়ার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়।

এভাবে প্রথমে প্রায় সব ভোটকেন্দ্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক ও এজেন্টমুক্ত করা হয়। এরপর টার্গেট করা হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। সকাল থেকেই বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে তাঁদের বাধা দেওয়া হতে থাকে। পরে তা মারধর করে আহত করা থেকে জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া পর্যন্ত গড়ায়। এভাবে গণমাধ্যমকেও কোণঠাসা করে সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে অবাধে কারচুপি করা হয়।

অবশ্য এ অবস্থার মধ্যেও অনেক কেন্দ্রে ভোটাররা গিয়ে ভোট দিতে পেরেছেন। সকাল থেকে দুপুর প্রায় ১২টা পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব কেন্দ্রেই ভোটাররা গিয়ে নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছেন। পরে অনেক কেন্দ্রেই ভোটারদের বের করে দিয়ে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়।

ভোটারদের আক্ষেপ: ঢাকার অনেক কেন্দ্রে অসংখ্য ভোটার ভোট দিতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। এ ধরনের সব ভোটারই ভোট দিতে না পেরে হতাশ হয়েছেন, আক্ষেপ করেছেন।

এমনই একজন ভোটার তাসলিমা বেগম। তাঁর স্বজনেরা প্রথম আলোকে বলেন, বয়োজ্যেষ্ঠ ও শারীরিকভাবে অসুস্থ এই নারী কয়েক দিন আগেও হাসপাতালে ছিলেন। ভোট দেওয়ার জন্যই তিনি তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল ছেড়েছেন। অথচ কাল বাসাবো বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন, তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।

দক্ষিণের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী এস এম নাজিমউদ্দিনকে ভোট দেওয়ার জন্য সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগম ও ভাবি আসিয়া সুলতানা। গিয়ে দেখেন, তাঁদের ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছেন। এরপর তাঁরা বুথের বাইরে বের হয়ে চিৎকার করে এর প্রতিবাদ জানান। এর ফলে জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনায় ওই কেন্দ্রে ভোট বাতিল করা হয়।

অন্য প্রার্থীদের ভোট বর্জন: উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্য মেয়র প্রার্থীরাও দুপুরের আগে ও পরে ভোট বর্জন করেন। সকাল সোয়া ১০টায় পুরান ঢাকার আমলীগোলা এএমসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর নির্বাচন বর্জনের কথা বলেন জাতীয় পার্টি-সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদপ্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সব কেন্দ্র সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। ব্যালট বাক্স আগে থেকেই ভরে রাখা হয়েছে।

ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী জোনায়েদ সাকি বেলা দুইটায় সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি পূর্ণ অনাস্থা ঘোষণা করেন।

একই সময়ে পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন-সমর্থিত দুই প্রার্থী ফজলে বারী মাসউদ ও আবদুর রহমান। এ ছাড়া চট্টগ্রামের তিন প্রার্থী বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন, ইসলামী আন্দোলনের মো. ওয়ারেছ হোসেন ভূঁইয়া ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও এই নির্বাচনকে তামাশা আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিরোধী দলকে কৌশলে বয়কট করিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নেয় সরকার। আর এবার তা ছিনিয়ে নিল ভোট ডাকাতি করে। এতে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসন সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। নির্বাচনের নামে তামাশার মাধ্যমে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়েছে।’
বেপরোয়া জালিয়াতি (সমকাল)

সমকাল প্রতিবেদক
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্র দখল, বেপরোয়া ভোট জালিয়াতি, এজেন্টদের মারধরসহ নানা অনিয়ম হয়েছে।

অনেক ভোটার অভিযোগ করেছেন, তিনি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পারেন, তার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। কিছু কেন্দ্রে সরকারদলীয় সমর্থকরা প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারে। বেশির ভাগ কেন্দ্রেই বিএনপি সমর্থক প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট ছিল না। কয়েকটি কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থক প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেওয়া হয়। সংঘর্ষ-হামলার ঘটনায় ভোট শুরুর কিছু সময় পরই কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়। পরে আবার চালু হয়।
পুলিশের সহায়তায় জাল ভোট :দুপুর ২টার দিকে ঢাকা দক্ষিণের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাংলাবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটার নেই। নিচতলার বুথে চার ব্যক্তি একজন পুলিশ সদস্যের সহায়তায় ব্যালট নিয়ে পছন্দের প্রতীকে সিল মারছেন। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে সরে পড়েন পুলিশ সদস্য।

প্রিসাইডিং অফিসার এ এফ এম ছানাউল্লাহর কাছে প্রকাশ্যে ভোট জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এমন অভিযোগ আসেনি।’ সাংবাদিকদের কাছে তথ্য পেয়ে নিচতলার বুথে আসেন তিনি। তার উপস্থিতিতেও চলতে থাকে জাল ভোট। তিনি তা বন্ধ করতে বললে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত একজন তাকে বলেন, ‘আপনাকে দোতলা থেকে নামতে বলছে কে?’ প্রিসাইডিং অফিসার তাদের হাত ধরে বলেন, ‘দয়া করে আর ভোট দেবেন না।

পত্রিকায় নাম এলে আমার অসুবিধা হবে।’ তবুও নিবৃত্ত হয়নি ভোট জালকারীরা। অন্তত দুইশ’ ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্সে ফেলে আধা ঘণ্টার মধ্যে।

বেলা ১১টায় উত্তর সিটির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতন কেন্দ্রে ব্যালটভরা বাক্স দেখা যায় প্রিসাইডিং অফিসার মিজানুর রহমান সরকারের কক্ষে। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি দরজা বন্ধ করেন। ছবি তুলতে গেলে সটকে পড়েন। কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। নারী ভোটকেন্দ্র হলেও প্রতিটি ভোট কক্ষে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের ব্যাজ পরা ৮-১০ জন করে যুবককে দেখা যায়।

কুর্মিটোলা হাই স্কুল :খিলক্ষেতের কুর্মিটোলা হাইস্কুলে দুপুর ১২টায় গিয়ে দেখা যায়, ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। কেন্দ্রের ভেতরে পাঁচটি বুথ ঘুরে কোনো বুথেই টেবিল ঘড়ি মার্কা ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। প্রিসাইডিং অফিসার হারুন উর রশীদ জানান, ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম হলেও শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ চলছে। কেন্দ্রের বাইরে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, সকাল ১০টার পর থেকেই বাস মার্কার এজেন্টসহ ভোটারদের বের করে দিয়ে কেন্দ্রের দখল নেয় ঘড়ি মার্কার লোকজন। ঢাকা উত্তরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে জামিয়া মোহাম্মদিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে দুপুর ২টার দিকে ভোটারদের বের করে কেন্দ্রের ফটক তালাবদ্ধ করে ব্যালট পেপারে সিল দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় :সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ভোট গ্রহণ শুরুর পর এ কলেজের এক নম্বর কেন্দ্রে দুই হাজার ৪৩৪ ভোটের মধ্যে এক হাজার ৬৫০ ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়। প্রতি মিনিটে প্রায় ১৪টি করে ভোট পড়ে। বিজয়নগর বধির হাইস্কুল, শাহজাহানপুরের মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট, গোড়ানের আলী আহমদ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও মডেল কলেজ, সবুজবাগের বাসাবো উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল কলোনি ক্লাবসহ প্রায় ২০ কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়।

উত্তরার চিত্র :উত্তরায় নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন বুথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যালটে সিল মারতে দেখা যায়। সে দৃশ্য ধারণ করতে গেলে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী নাজেহাল হন। এই কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোটের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরও বিভিন্ন বুথে ঢুকে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা একের পর এক ব্যালটে সিল মেরে তা বাক্সে ঢোকান। তাদেরই কয়েকজন ব্যালট বইয়ের মুড়ির অংশে টিপসই দিচ্ছিলেন। পরে প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে ব্যালট বাক্সগুলো জমা দেওয়া হয়।

ঢাকা কলেজে গণজালভোট :ঢাকা কলেজ কেন্দ্রে সকাল ৯টার দিকে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মী অতর্কিত ঢুকে জাল ভোট দিতে শুরু করে। অন্তত ২০ মিনিট জাল ভোট দিয়ে তারা বুথ থেকে বেরিয়ে আসে। এ সময় অন্যান্য সাধারণ ভোটারকে তারা ভেতরে যেতে বাধা দেয়।

এদিকে, ঢাকা উত্তরে ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী সলিমুল্লাহ সলু ও নুরুল ইসলাম রতনের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দিনভর উত্তেজনা ছিল। রতন সম্পর্কে সলুর বড় বোনের স্বামী। মিরপুরের পল্লবীর ২ নম্বর ওয়ার্ডে বাংলাদেশ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে তাবিথ আউয়ালের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাবিথের এজেন্ট নুরুন্নবী সাংবাদিকদের বলেন, আনসার সদস্যরা তাকেসহ অন্তত ২০ জনকে মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়।

সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় :বংশালের সুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এর পর এ কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের জাল ভোট দেওয়া নিয়ে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

ব্যালট পেপারে আগুন :কমলাপুরে বেলা ১১টার দিকে শেরেবাংলা রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সরকার সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারার প্রতিবাদে বিএনপি সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষের লোকজন ৫ নম্বর বুথে ভাংচুর করে। এ সময় তারা কিছু ব্যালট পেপারে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভাংচুর করে চেয়ার-টেবিল। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

কমলাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ :দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় কমলাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। ওই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মুন্সি কামরুজ্জামান কাজলের ঘুড়ি এবং মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের ইলিশ মাছ প্রতীকে সিল মারতে দেখা গেছে। প্রায় অর্ধশত ভোটারকে ভোট দিতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করে চলে যেতে দেখা গেছে। ভোট গ্রহণ স্থগিত করে পুনঃভোটের আবেদন করেন কাউন্সিলর প্রার্থী আবু জুবায়ের মো. মিরাতিল্লাহ। তিনি নিজেও ভোট দিতে পারেননি। মির্জা আব্বাসের এজেন্টকে এই কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সকাল পৌনে ১০টার দিকে প্রিসাইডিং অফিসার শেখ আরিফুল ইসলাম বলেন, তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ব্যালট পেপারে অবৈধভাবে সিল মারার ঘটনা তিনি সমকালের কাছে স্বীকার করেন।
সংঘর্ষের জের ধরে বেলা ১১টার দিকে মানিকনগর মডেল হাইস্কুল কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশের উপস্থিতিতে সরকার সমর্থকরা শাহজাহানপুর মির্জা আব্বাস মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপারে সিল মারে। সেগুনবাগিচা হাইস্কুল কেন্দ্রে নারী বুথে ঢুকে পুরুষ ভোটারদের ভোট দিতে দেখা গেছে।

উদয়ন হাই স্কুল :ভোট শুরুর পর উদয়ন হাই স্কুল কেন্দ্রের সামনে জড়ো হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল শাখার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। প্রিসাইডিং অফিসার আবদুল মতিন বলেন, ‘নিরপেক্ষভাবে ভোট গ্রহণের চেষ্টা করছি। পরে কী হবে, সেই শঙ্কায় রয়েছি।’ একাধিক সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, ‘ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতারা জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ চাচ্ছে। জাল ভোট ঠেকানোর চেয়ে জীবন বাঁচানো জরুরি।’ দুপুর ১২টার দিকে ঢাবি বিজ্ঞান ভবনের কার্জন হলের প্রিসাইডিং অফিসার মুহম্মদ হিরন চৌধুরী বলেন, ‘ভোটাররা সব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাই কিছু দৃশ্য দেখেও চুপ থাকতে হয়। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাও জরুরি।’
ধানমণ্ডি, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ ও মোহাম্মদপুরের চিত্র :কাঁঠালবাগান, ধানমণ্ডি, জিগাতলা, হাজারীবাগ ও রায়েরবাজারে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। তবে আইডিয়াল কলেজ কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংবাদকর্মীরা ছবি তুলতে গেলে নাজেহাল হন। ভিন্ন চিত্র ছিল মোহাম্মদপুরে। এ এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্ট ছিলেন।

যাত্রাবাড়ী, ফরিদাবাদ, গেণ্ডারিয়ায় কারচুপি ও উত্তেজনা :যাত্রাবাড়ী, ফরিদাবাদ, গেণ্ডারিয়ার বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট কারচুপি হয়েছে। ফরিদাবাদের মোহাম্মদ শফিক ও আমজাদ হোসেন নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেননি। শহীদ জিয়া গার্লস স্কুল শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়-৩, মাদ্রাসা মুহাম্মদীয়া আরাবিয়া, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল, যাত্রাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আর কে চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ, গোলাপবাগ আদর্শ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র ঘুরে নানা অনিয়মের দৃশ্য চোখে পড়ে। যাত্রাবাড়ীর গোলাপবাগের এমএ রাজ্জাক সকালে আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে তাকে বের করে দেওয়া হয়।

অধিকাংশ কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট ছিল না বিএনপির : সকাল ১০টা থেকে অধিকাংশ কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট ছিল না। কাঁঠালবাগান, ধানমণ্ডি, জিগাতলা, হাজারীবাগ ও রায়েরবাজারের ভোটকেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কাঁঠালবাগানের খান হাসান আদর্শ প্রাইমারি বিদ্যালয় কেন্দ্রের গেটে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কলাবাগান যুবলীগ নেতা নাজিমউদ্দিন বাবুর নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক অবস্থান নেয়। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্ট গেলে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

ডিজিটাল জমানায় এনালগ কারচুপি (মানবজমিন)
বিশেষ প্রতিনিধি
এ এক নয়া মডেলের নির্বাচন। উৎসব তো বটেই। দখলের উৎসব। একেবারেই খোলামেলা। কোন রাখডাক নেই। সকাল সকাল প্রায় প্রতিটি কেন্দ্র থেকেই হাওয়া বিএনপি সমর্থক এজেন্টরা। কেউ ঢুকতে পেরেছেন, কেউ পারেননি। তবে থাকতে পারেননি কেউই। হুমকি, মারধর, হামলা আর গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন তারা। কাউকে কাউকে আটকে রাখা হয় আগেই। রক্তাক্ত এজেন্ট যেন একটি নির্বাচনেরই প্রতিচ্ছবি। আভাস পাওয়া গিয়েছিল আগের রাতেই। খবর আসছিলো, ব্যালট পেপারে সিল মারার। যদিও তার সংখ্যা ছিল কম। তবে গতকাল দিনের শুরুতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথম বাধার শিকার গণমাধ্যম। বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ক্যামেরা নিতে মানা। দিনভর টার্গেট সাংবাদিকরা। কেন্দ্র বিরোধী এজেন্টমুক্ত করার পর বিরোধী ভোটারমুক্তও করা হয়। প্রতিটি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল তাদের শতভাগ সহযোগী। কোথাও কোথাও অগ্রণী ভূমিকায়। কেন্দ্রের সামনে বিরোধীরা যেন আসতে না পারেন তা নিশ্চিত করা হয় শতভাগ। এরইমধ্যে চলে গায়েবি ভোট। প্রকাশ্যে ব্যালটে সিলমারা। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরাই শুধু নয় এমনকি কোথাও কোথাও নির্বাচনী কর্মকর্তাদেরও দেখা গেছে ব্যালটে সিল মারতে। কোথাও কোথাও ভোটাররা ভোট দিতে গেলে বলা হয়, দেরি করে ফেলেছেন। অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে কয়েকটি কেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। বলাবাহুল্য, এ সংঘর্ষ হয়েছে সরকারি দলের কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যেই। সার্বিক পরিস্থিতিতে দুপুরেই নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, একশ’ ভাগ ভোট পড়লেও অবাক হবো না। তবে এতো কিছুর পরও সেনা সদস্যরা অবশ্য মোতায়েন ছিলেন সেনানিবাসেই। কোথাও তাদের ডাকার প্রয়োজন মনে করেনি নির্বাচন কমিশন। সারাদিনের ঘটনাপ্রবাহ দেখে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ যেন জোর যার, ভোট তার। কেউ কেউ বলছেন, ডিজিটাল জমানায় এনালগ কারচুপি।

ভোটের শুরুতেই নানা কেন্দ্র থেকে খবর আসতে থাকে বিএনপির নেতৃত্বের কাছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরে হতাশাজনক চিত্র দেখেন প্রার্থীরা। দ্রুতই এগুতে থাকেন নির্বাচন বর্জনের দিকে। প্রথম ঘোষণা আসে অবশ্য চট্টগ্রাম থেকে। বেলা ১২টার আগেই কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে যান মনজুর আলম। একইসঙ্গে রাজনীতি থেকেও অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পর ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন- উত্তরের মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল এবং দক্ষিণের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। মওদুদ আহমদ বলেন, র্যাব-পুলিশ এবং সরকারি দলের লোকজন আমাদের সব এজেন্টকে বের করে দিয়েছে। এটা কোন নির্বাচন হয়নি। এটা একটি ভোটবিহীন প্রহসনের নির্বাচন। এ নির্বাচনকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। তবে শুধু বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীই নয়, আলোচিত বেশির ভাগ মেয়রপ্রার্থীই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তাদের মধ্যে জাতীয় পার্টি, সিপিবি সমর্থিত প্রার্থীরা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন জোনায়েদ সাকী, গোলাম মাওলা রনির মতো প্রার্থীরা। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগ। যদিও দিনভর জালভোটের উৎসব আর বিএনপির বর্জনের পর এ নির্বাচনে কারা জয়ী হচ্ছেন তা নিয়ে অবশ্য কারো কোন আগ্রহ ছিল না। তিন ক্ষমতাসীন সমর্থিত প্রার্থীর নাম- ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন, চট্টগ্রামে আ.জ.ম নাছির উদ্দিন।
কলঙ্কজনক ভোট বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তবে সবকিছু এত খোলামেলা হওয়ার ঘটনা সম্ভবত এবারই প্রথম। একদিনের বাদশারা তাদের রায় দিতে পারবেন কি-না তা নিয়ে আগেই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল, নজিরবিহীন ভোটের। ভোট নজিরবিহীনই হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মঙ্গলবার কোন মঙ্গল বয়ে আনেনি। গায়েবি ভোটের উৎসবে ম্লান হয়েছে গণতন্ত্র। বেশির ভাগ মানুষই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। এ নিয়ে বেশি বলাও অবশ্য মুশকিল। কিছু কিছু পত্রিকা বলেছিল, এ নির্বাচন হবে গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে বলা যায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আরও একবার পরাজিত হয়েছে।

নির্বাচন বর্জন করলেন যারা-
২০দলীয় জোট ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন, স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম মাওলা রনি, জোনায়েদ সাকীও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। এছাড়া, জাতীয় পার্টির সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীরা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যাপক কারচুপি ও সরকারসমর্থিত প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্র দখলের প্রতিবাদে এই ঘোষণা দিয়েছেন তারা। গতকাল দুপুরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই বর্জনের ঘোষণা দেন মেয়রপ্রার্থীরা। এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়রপ্রার্থী মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়রপ্রার্থী আলহাজ আব্দুর রহমান, সংগঠনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমদ, রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, মাওলানা ইমতিয়াজ আলম, কেন্দ্রীয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, মাওলানা আহমদ আব্দুল কাইয়ুম, কেএম আতিকুর রহমান প্রমুখ। প্রার্থীরা বলেন, ভোটগ্রহণ শুরুর পর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্ট বের করে দেয়া, জালভোট প্রদান ও ভোটকেন্দ্র দখল করে সরকারদলীয় প্রার্থীদের ভোট প্রদানসহ নানা অনিয়মের খবর পাওয়া গেছে। এহেন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে গেছে বলে আমরা মনে করছি। এ প্রহসনের নির্বাচনকে আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই আমরা এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছি। চট্টগ্রাম থেকেও আমাদের মেয়র প্রার্থী ওয়ায়েজ হোসেন ভূঁইয়া নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমদ বলেন, নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী না নামিয়ে সরকারসমর্থিত প্রার্থীদের ভোট ডাকাতির সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা এ নির্বাচন বর্জন করছি এবং এ নির্বাচন বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি।

এদিকে বিরোধী জোটের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আসার পর ঢাকা উত্তরের মেয়রপ্রার্থী জোনায়েদ সাকীও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল দুপুরে নিজ নির্বাচনী কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন। সাকী বলেন, যেভাবে কেন্দ্র দখল করা হয়েছে, ব্যালট ছিনতাই করা হয়েছে তাতে এই ভোট ও ফল মেনে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। এ কারণে আমি নির্বাচন ও ফল প্রত্যাখ্যান করছি। এছাড়া ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী গোলাম মাওলা রনি। বিকাল তিনটার দিকে তিনি নির্বাচন বর্জনের এ ঘোষণা দেন। তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে এক স্ট্যাটাসে রনি লেখেন, ‘অন্যসব প্রতিযোগীর মতো আমিও এই নির্বাচন বর্জন করলাম। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন টিভিতে দেখছিলাম, আর ২৮শে এপ্রিলের নির্বাচন চর্ম চোক্ষে দেখলাম। এও কি সম্ভব! ইয়েস, ‘রংগে ভরা বঙ্গে সবই সম্ভব’।
এর আগে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ঢাকার দুই সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মেয়র প্রার্থী আবদুল্লাহ ক্বাফী এবং দক্ষিণে বজলুর রশীদ ফিরোজ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ভোটকেন্দ্র সরকারি দলের নেতাকর্মীরা দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ঢাকা দক্ষিণ জাতীয় পার্টি সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন। সকাল ৯টায় লালবাগের আমলীগোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট প্রদান শেষে তিনি এ অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেনি।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend