বস্ত্রহরণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার পাঁয়তারা

Jjjjনারীর বস্ত্রহরণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। বিভিন্ন পেশাজীবী, ছাত্র ও মানবাধিকার সংগঠনগূলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অপরাধীদের আড়াল করা হচ্ছে। পুলিশের কথিত তিনস্তরের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীদের বস্ত্রহরণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার ৭ দিনেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে না পারায় এসব প্রশ্ন ওঠেছে। জনমনে সৃষ্টি হয়েছে চরম ক্ষোভ বিক্ষোভ।

ভিডিও ফুটেজ দেখে কয়েকজনকে শনাক্ত করলেও পুলিশ তাদর পরিচয় প্রকাশ করছে না। অভিযোগ ওঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। তাদের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে অপরাধীরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মুখ খুলতে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপের অভিযোগ উঠেছে পুলিশ প্রশাসনের প্ররুদ্ধে। ঘটনার পর ভিডিওতে যৌন নিপীড়নের সচিত্র প্রতিবেদন হাতে পাওয়া গেলেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কয়েকজনকে চিহ্নিত করা গেলেও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছেন না পুলিশের কোনো কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনো রকম বক্তব্য দিতে এক ধরনের অপারগতা প্রকাশ করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন উপরের নির্দেশে এ বিষয়ে আমাদের মুখ খোলা নিষেধ রয়েছে। অন্যদিকে গতকাল মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানও বলেছেন, এ ব্যাপারে পুলিশের গাফিলতি রয়েছে। সব কয়টির মধ্যে একটি ভিটিও ফুটেজের চিত্র রহস্যজনক কারণে প্রকাশ করা হচ্ছে না।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশের যেসব কর্মকর্তারা বলছেন নারীর বস্ত্রহরণ কিংবা যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ওই দিন ঘটেনি তারা মিথ্যা বলছেন এবং এ কথা বলে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার ইব্রাহিম ফাতেমী গতকাল বলেছেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। খোঁজ-খবর নিচ্ছি। কারো কাছে কোন তথ্য থাকলে তা জানানোর জন্য বলা হয়েছে।

অন্যদিকে ভিডিও ফুটেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, মিথ্যাচারের অভিযোগ উঠেছে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা দাবি করছেন রাজু ভাস্কর্যের সামনে উদ্যানের গেটের সামনের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করছে না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে সকল ভিডিও চিত্রই প্রকাশ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে টিএসসির ঘটনা নিয়ে বস্ত্রহরণের যে মর্মান্তিক দৃশ্যের অভিযোগ করা হয়েছে সে রকম কোন ঘটনাই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়নি। এছাড়া ঘটনার দিন ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সভাপতি লিটন নন্দী নিজের পাঞ্জাবি খুলে মেয়েটিকে জড়িয়ে দিয়েছিলেন সে রকম কোন ভিডিও দেখা যায়নি।

প্রসঙ্গত নববর্ষের দুদিন আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে নববর্ষের নিরাপত্তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছিলেন, ‘পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে, যা ডিএমপির সদর দপ্তর থেকে মনিটর করা হবে। ইউনিফর্ম ও সিভিল পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কয়েক স্তরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন।’ কিন্তু এই কয়েক স্তরের নিরাপত্তা নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠেছে। “তিন স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা” আসলেই কেমন ছিল তাও খতিয়ে দেখার বিষয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রথম স্তরে জনস্রোতে মিশে থাকার কথা ছিল সিভিল পোশাক পরিহিত কয়েকশ পুরুষ এবং মহিলা পুলিশ। এদের প্রত্যেকের কাছে না হলেও প্রতি ১০ অথবা ২০ জনের সাথে অন্তত একজনের কাছে যোগাযোগ ব্যবস্থা বা ওয়াকি টকি থাকা উচিত। প্রতিটি দল সুনির্দিষ্ট অবস্থানে একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা এবং রেডিওতে (ওয়াকি টকি) সুনির্দিষ্ট কল সাইন ব্যবহার করার কথা। প্রতিটি দল একে অপরের অবস্থান অবশ্যই জানার কথা ছিল। এই দলের সদস্যরা দায়িত্ব পালনের সময় নিজ দল এবং কাছাকাছি হলে অন্য দলের দিকে মাঝে মাঝে খেয়াল রাখার কথা। এদের মধ্যে দলনেতার কাছে গোপনে ছোট অস্ত্র থাকতে পারে। আর অন্য অনেকের কাছে (হয়তো প্রতি পাঁচজনে একজন) হাই ভোল্টেজ শক গান (High Voltage Shock Gun A_ev Stun Gun) থাকতে পারতো। তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তার এটাই হতো আদর্শ প্রথম স্তর। এমন কথাই বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, সিসি ক্যামেরাগুলো কি পুলিশের তথাকথিত তিন স্তরের কোন একটি সুনির্দিষ্ট স্তর ছিল কি না। তিন স্তরের শেষ স্তরে ঠিক কি ছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়। ১৩১টি ক্যামেরার সবগুলো চালু ছিল নাকি তাও জানা যায়নি। প্রতি মনিটরে কয়জন অপারেটর ছিলেন, তাদের সাথে ফিল্ড টিমের তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল কি না, ফিল্ড টিমের কে কোথায় আছে সে সম্পর্কে সিসিটিভি মনিটরের দায়িত্বে থাকা অপারেটরের সুস্পষ্ট জ্ঞান ছিল কি না এ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সিসি ক্যামেরাগুলোর সাথে দিক (Direction) অথবা জুম (Zoom) নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সংযোজিত থাকলে অপরাধীদের শনাক্ত করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

অভিযোগ ওঠেছে, ১৩১টা সিসি ক্যামেরা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে, মাঠ পর্যায়ে সমন্বয় করে বসানো হয়নি। সেগুলো পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিল তাদের সাথে ফিল্ড পর্যায়ের কোন যোগাযোগ বা সমন্বয় ছিল না। তারা দায়িত্ব পালনেও মারাত্মক অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন। পুলিশের বসানো সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজে নারীদের লাঞ্ছিত করার অন্তত ১০টি দৃশ্য ধরা পড়লেও, পুলিশকে ঘটনাস্থলে এসেছে একদম শেষ পর্যায়ে।

সিসি ক্যামেরা বসিয়ে অপরাধ সংঘটনের ছবি তোলা এবং অপরাধ ঘটে যাওয়ার পরে ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করতে গলদঘর্ম হওয়ার চেয়ে অপরাধ ঘটার মুহূর্তেই তা ঠেকানোর প্রয়োজন ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। ওদিকে লিটন নন্দী জানিয়েছেন, ওই দিন তিনি বিবস্ত্র মেয়েটির লজ্জা ঢাকতে নিজের পাঞ্জাবি খুলে তাকে পড়তে দিয়েছিলেন। ভিডিও ফুটেজ নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন এবং পুলিশ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নিয়ে ক্যাম্পাসে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠেছে।

তবে প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন ধারণা করছেন যে ভিডিওচিত্রে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তারা কেউ-ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ছবি পোস্টার ও টেলিভিশন মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হবে বলে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ।

তিনি বলেন, ভিডিও ফুটেজে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের ছবি আমার হাতে এসেছে। টেলিভিশন মিডিয়ায় অথবা পোস্টারিং আকারে তা প্রচার করা হবে। যাতে করে সন্ত্রাসীদের সবাই চিনতে পারে।

এদিকে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি সভাপতি লিটন নন্দী বলেন, টিএসসির ঘটনা নিয়ে প্রক্টরের মিথ্যাচার, ঘটনার প্রবাহ অন্যদিকে ঘুরানো এবং ঘটনার ৭ দিন পরও কাউকে সনাক্ত না করতে পারায় আমরা তার অপসারণ দাবি করছি। এদিকে টিএসসির বস্ত্রহরণের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নারী নির্যাতন ও যৌন প্রতিরোধ কমিটির তাদের তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

গতকাল দুপুরে টিএসসির ঘটনার ভিডিও চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহবাগ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে আমাদের মুখ খোলা নিষেধ রয়েছে। তবে ঘটনার তদন্তের স্বার্থে পুলিশ প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য তিনি আহ্বান জানান। শাহবাগ থানার অপারেশন অফিসার এ কে আজাদ জানান, ভিডিও চিত্র এবং এ জাতীয় কোন বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবো না। তবে ভিডিও চিত্র দেখে যা বোঝা যাচ্ছে ঘটনার যেভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার সাথে মিলছে না।

সৌজন্যে: ইনকিলাব

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend