সব ভয় গতিমানবদের নিয়ে

banglaনিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অপরাজিত দল হিসেবে বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব ডিঙানোর খুব কাছে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ড। কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবে যায় নাকি, সেই আশঙ্কায় পড়েছে ব্র্যান্ডন ম্যাককুলামের দল। কারণ এমন অর্জনে সামনে একটাই বাঁধা তাদের, যেখানে দাঁড়িয়ে উজ্জীবিত টিম বাংলাদেশ। যে দলের কাছে একাধিকবার ম্যাচ হারার রেকর্ড রয়েছে ম্যাককুলামদের। রেকর্ড রয়েছে হোয়াইটওয়াশ হওয়ারও। বাংলাদেশকে তাই সমীহ করতে বাধ্য হচ্ছে দুরন্ত গতিতে থাকা কিউইরা। আর সেই কিউইদের মোকাবেলায় বাংলাদেশ আবার সমীহ করছে স্বাগতিক পেসারদের। ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি, অ্যাডাম মিলনে কিংবা কোরে অ্যান্ডারসনরা এবারের আসরে যে ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছেন! তবে ভীতি ছড়িয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা-রুবেল হোসেনরাও। তাই তো নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ম্যাককুলামও বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘বাংলাদেশের পেসাররা বড় ভয়ঙ্কর।’ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ড-বাংলাদেশ ম্যাচটি যেন হয়ে উঠেছে ব্যাটসম্যানদের জন্য গতির বোলাদের মোকাবেলা করার ভীতিকর ম্যাচ হিসেবে।
শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচ খেলতে নামবে এ দুই দল। ম্যাচ শুরু হবে বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টায়। এর আগে আলোচনায় দুই দলের পেসাররা আরেকজন ব্যাটসম্যান, যার নাম ব্র্যান্ডন ম্যাককুলাম।
২৯ মার্চ, ২০১৫; এই দিনটির মধ্যে বিশেষ মাহাত্ম্য খুঁজতে শুরু করেছেন নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ভক্তরা। কেন? উত্তর লুকিয়ে রয়েছে ৬২ বছর আগের আরেকটি তারিখে। সেই ১৯৫৩ সালের কথা; ওই বছর পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে হিমালয় জয় করেছিলেন অ্যাডমান্ড পার্সিভেল হিলারি নামক এক পর্বতারোহী। এ জন্য সন্মানসূচক ‘স্যার’ উপাধিও পেয়েছিলেন। নেপালের হিমালয় জয় করা হিলারি নিউজিল্যান্ডের মানুষ। এই বিজয়ে নিউজিল্যান্ডের পতাকাকে পৃথিবীর উচ্চ শিখরে স্থাপন করেছেন তিনি। এবার হিমালয়ের মতোই আরেকটি শৃঙ্গ জয়ের মুকুট মাথায় পরার আকাঙ্ক্ষা কিউইদের। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা। আর সেখানেই তাদের প্রেরণা যোগাচ্ছে ২৯ মার্চ, ২০১৫ তারিখটি। কেননা ওই তারিখেই তো অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এবারের ফাইনাল ম্যাচটি।
আর মাস ভিন্ন হলেও ২৯ তারিখ বলে কথা; হিলারির মতো তাই ব্র্যান্ডন ম্যাককুলামের হাত ধরে ওই তারিখে নিউজিল্যান্ডের পতাকা আরেকবার পৃথিবীতে উপরে শোভা পাবে, এমন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কিউইরা।
আরও অনেক কাকতালীয় ঘটনাও খুঁজে পাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। তারিখ মিলে যাওয়ার পাশাপাশি ‘মার্চ’ ও ‘মে’ মাস দুটির ইংলিশ বানানে প্রথম দুই অক্ষরের মিল। ১৯৫৩ আর ২০১৫ সাল দুটি বেজোড়। দুই সালের অঙ্কগুলোর যোগফল আবার জোড়। এমন সব মিলের কারণে নিউজিল্যান্ডদের বিশ্বাস দৃঢ় হতে শুরু করেছে। বিশ্বকাপ শিরোপা নিয়ে উৎসব করতে না পারার হাহাকার তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্বপ্ন ডালাপালা মেলছে। তাদের বিশ্বাস, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ২৯ মার্চ তার অবসান হবে!
ব্র্যান্ডন ম্যাককুলাম বাহিনী এবারের আসরে যেমন বিধ্বংসী পারফরম্যান্স করে চলেছে, তাতে নিউজিল্যান্ডের মানুষের এই স্বপ্ন-প্রত্যাশাকে মোটেও হেসে উড়িয়ে দেওয়া চলবে না। গ্রুপপর্বে একের পর এক দলকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইতোমধ্যে ছোট্ট ইতিহাসটা গড়ার (গ্রুপপর্বে অপরাজিত থাকা) দ্বারপ্রান্তেও তারা।
কোয়ার্টার ফাইনাল আগেই নিশ্চিত হওয়ায় ম্যাচটি দু’দলের জন্যই গুরুত্বহীন। এই ম্যাচে হার-জিতের কারণে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার বিষয়টিতে প্রভাব পড়বে না। কিন্তু বুকের ভেতরে থাকা আত্মবিশ্বাসের পারদের ওঠা-নামায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে ম্যাচটি। এটি নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে যেমন, তেমন সত্য বাংলাদেশের জন্যও। সর্বশক্তি নিয়েই এই ম্যাচে মাঠে নামতে প্রস্তুত বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড। অন্তত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে এবং নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ব্র্যান্ডন ম্যাককুলামের কথায় তেমন ইঙ্গিতই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
ইনজুরির কারণে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফির মাঠে নামার বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। কিন্তু যতটুকু খবর, তাতে মাশরাফি নিজেও ম্যাচটি মিস করতে চান না। মাশরাফির খেলা না খেলার বিষয়টি নির্ধারিত হবে ম্যাচ শুরুর আগে। এর আগে বাংলাদেশ এই ম্যাচের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছে।
মাত্র ১৮ বলে হাফসেঞ্চুরি; বিশ্বকাপের দ্রুততম হাফসেঞ্চুরিয়ান ম্যাককুলামের ঝড়ো ব্যাটিং করার ক্ষমতা নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছে বাংলাদেশ। তাকে আটকানোর পরিকল্পনা সাজাতে গিয়ে তাই স্পিনার তাইজুল ইসলামকে (অভিষেক ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক করা ইতিহাসের একমাত্র বোলার) দলে নেওয়ার চিন্তাভাবনাও চলছে। কারণ গতির বলে ম্যাককুলামের কোনো সমস্যা নেই, যত সমস্যা স্পিনে। তবে চলতি বিশ্বকাপের পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা- ম্যাককালাম নয়, ভয়ের আসল কারণ নিউজিল্যান্ডের গতিমানবরা।
ম্যাককুলাম বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের ক্ষমতা রাখেন বটে, তবে চলতি আসরে খুব বেশী কিছু করে দেখাতে পারেননি এখনো। দ্রুততম হাফসেঞ্চুরি কথাটি বাদ দিলে আহামরি কোনো ইনিংস নেই নিউজিল্যান্ড অধিনায়কের।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটি খেলতে নামার আগে ৫ ম্যাচে ব্যাটিং করেছেন। তাতে ম্যাককুলামের সংগ্রহ ২৪৯ রান। ৩টি দ্রুতগতির হাফসেঞ্চুরি করলেও কোনো সেঞ্চুরি করতে পারেননি। সর্বোচ্চ ইনিংস ৭৭ রানের। চলতি আসরে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী কেইন উইলিয়ামসন ৫ ম্যাচে করেছেন ১৮২ রান। মার্টিন গুপটিল ৫ ম্যাচে করেছেন ১৫৬ রান।
ব্যাটিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বাংলাদেশই বরং নিউজিল্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে থাকছে। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক মুশফিকর রহিম ৪ ম্যাচ খেলে ২৫৬ রান করে সেরার তালিকায় ব্র্যান্ডন ম্যাককুলামের চেয়ে দুই ধাপ উপরে রয়েছেন। তার হাফসেঞ্চুরি ইনিংস ৩টি, সেরা ইনিংস ৮৯ রানের। নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করা উইলিয়ামসন যখন ২৯তম স্থানে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তখন ৪ ম্যাচে ২১৬ রান নিয়ে রয়েছেন তালিকার ২৩তম স্থানে। তার ব্যাটেই চলতি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম সেঞ্চুরি পেয়েছে। বাংলাদেশের তৃতীয় সেরা রানকারী সাকিব আল হাসান ৪ ম্যাচে ১৬৩ রান নিয়ে রয়েছেন তালিকার ৩৫তম স্থানে। ব্যাটিং নিয়ে তাই বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কারণ নেই।
তবে নিউজিল্যান্ডের বোলিং পরিসংখ্যানটা যে কোনো দলের জন্যই ভয়ের কারণ হতে পারে। আসরের সেরা ৬ বোলারের তালিকায় তিনজনই নিউজিল্যান্ডের। কিউই পেসার ট্রেন্ট বোল্ট ৫ ম্যাচে ১৩ উইকেট নিয়ে রয়েছেন তালিকার দ্বিতীয় স্থানে (১ নম্বরে রয়েছেন স্কটল্যান্ডের ডেবি)। আরেক পেসার টিম সাউদি ৫ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে রয়েছেন তালিকার চতুর্থ স্থানে। আর অভিজ্ঞ ড্যানিয়েল ভেট্টরি তার স্পিন জাদুতে ৫ ম্যাচে নিয়েছেন ১২ উইকেট, রয়েছেন তালিকার ৬ নম্বরে। মারকুটে ব্যাটসম্যান বলে খ্যাতি পাওয়া কোরে অ্যান্ডারসনও তার মিডিয়াম গতির বল দিয়ে ৫ ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়েছেন।
বাংলাদেশের ৩ পেসার মাশরাফি বিন মর্তুজা, রুবেল হোসেন ও তাসকিন আহমেদ প্রত্যেক্যেই ৪ ম্যাচ খেলে ৬টি করে উইকেট নিয়েছেন। তালিকার ৩২তম স্থানে মাশরাফি, ৩৩তম স্থানে রুবেল এবং ৩৫তম স্থানে অবস্থান তাসকিনের। সেরা ৫০ বোলারের তালিকায় ঢুকতে পারেননি বাংলাদেশের আর কোনো বোলার।
বাংলাদেশের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে মাত্র এক ম্যাচেই প্রথম ব্যাট করেছে নিউজিল্যান্ড। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে আগে ব্যাট করে ৬ উইকেট ৩৩১ রান করেছিল কিউইরা। সেখানেই ম্যাককুলাম ও গুপটিল উদ্বোধনী জুটিতে ১৫.৫ ওভারে ১১১ রান যোগ করেছিলেন। এই রান তাড়া করার ক্ষমতা থাকলেও (পরের ম্যাচগুলোতে যা লঙ্কানরা প্রমাণ করেছে) কিউই পেসারদের কৃতিত্বের কারণে মাত্র ২৩৩ রানে গুটিয়ে গেছে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের দল। পরের ম্যাচগুলোতে তুলনামূলক দুর্বলতা ধরা পড়েছে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪২ রান তাড়া করতে গিয়ে ৭ উইকেট হারানো কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৫১ রান তাড়া করে ম্যাচ জিততে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলার ঘটনা। কিন্তু তাদের বোলাররা এখন অবধি কোনো প্রতিপক্ষকে পুরো ৫০ ওভার ব্যাটিং করতে দেয়নি।
মাশরাফিরা ছন্দে থাকলে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং নিয়ে ভয় পাওয়ার কারণ নেই বাংলাদেশের। দুশ্চিন্তা থাকছে স্বাগতিকদের পেসারদের নিয়ে। মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ-সাকিব-তামিমরা যদি সাউদি-বোল্টদের সামলাতে পারেন তাহলে আরেকটি অর্জনের আশা করতেই পারে বাংলাদেশ। অধিনায়ক মাশরাফিও তাই বলেছেন।
এদিকে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ম্যাককুলাম নিজেও বাংলাদেশের বোলিং নিয়েই ভয় প্রকাশ করেছেন। ম্যাককুলাম বলেছেন, ‘যা দেখলাম তাতে এটুকু বুঝেছি, বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পেসাররা এখন অনেক ভয়ঙ্কর। ম্যাচটা সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে।’
দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে নিজ মাটিতে টানা ৭ ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। তবে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বরাবরই হারতে হয়েছে টাইগারদের। বিশ্বকাপের ৫ ম্যাচসহ বর্তমানে টানা ৭ ম্যাচ জয়ের ট্রেনে রয়েছে ম্যাককুলামের দল। তবে এ সব পরিসংখ্যানে কোনো আগ্রহ নেই বাংলাদেশ দলের কোচের। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছেন, ‘অতীতে কী হয়েছে না হয়েছে তা আমি জানতে চাই না। একটাই কথা জানি, ভাল খেলতে হবে; তবেই ম্যাচ জেতা সম্ভব।’
বৃহস্পতিবার বেশ বৃষ্টি হয়েছে হ্যামিল্টনে। শুক্রবারও হালকা বৃষ্টির সম্ভবনা রয়েছে। অবশ্য স্থানীয় আবহাওয়া অফিস বলেছে, শুক্রবার রৌদ্রোজ্জ্বল থাকবে সেডন পার্কের আকাশ। তাপমাত্র থাকতে পারে ২৬ ডিগ্রির কাছাকাছি।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend