পেট্রোলবোমায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই

Petrol_bomb_1কোনোভাবেই পেট্রোলবোমা হামলা রুখতে পারছে না সরকার। চলমান অবরোধ ও হরতালে এ ধরনের হামলা বাড়ছে। মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। গত ৬ জানুয়ারির পর থেকে চলমান আন্দোলনে এ পর্যন্ত সারাদেশে পেট্রোলবোমা হামলা ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন অন্তত ৪৭ জন।
শুধু গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত গাইবান্ধা ও বরিশালে পৃথক দু’টি পেট্রোলবোমা হামলায় নিহত হয়েছেন ৯ জন। এ নিয়ে চলমান আন্দোলনে রাজনৈতিক সহিংসতায় দেশে ৭৮ জন নিহত হলেন।
গাইবান্ধায় শুক্রবার রাতে ও বরিশালে শনিবার ভোরে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় ৯ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অন্তত ৩০ ব্যক্তি দগ্ধ হয়েছেন। গাইবান্ধায় পুলিশ প্রহরার মধ্যেই দুর্বৃত্তরা পেট্রোলবোমা ছুড়ে।
এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে কুমিল্লায় একটি নাইটকোচে ছোড়া পেট্রোলবোমায় ৮ জন নিহত হয়েছেন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন আরও অন্তত ২৩ যাত্রী। গত ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় ২৯ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে নূর আলম নামে এক যাত্রী ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়তই ঘটছে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তারা ভর্তি হচ্ছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। অবরোধ ও হরতালে সহিংসতার শিকার হয়ে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৯ জন। চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন আরও অন্তত ৬০ জন। এখনো চিকিৎসাধীন আছেন ৬৪ জন। এ সব রোগীর সবাই সাধারণ মানুষ।
হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসাধীন এ সব রোগীর দিন কাটছে অসহ্য যন্ত্রণায়। পরিবার-পরিজনরা আছেন উৎকণ্ঠায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কথা হয় যাত্রাবাড়ীতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ শরীফ খানের স্ত্রী মাসুমা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শরীফ। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাদের সংসার। নারায়ণগঞ্জের রুপসী এলাকায় তাদের বাসা। ঢাকার বিভিন্ন শপিংমলে শরীফ শাড়ির যোগান দিতেন। ঘটনার দিন শাড়ির যোগান দিয়ে বাসায় ফেরার পথে পেট্রোলবোমা হামলার শিকার হন।
তিনি বলেন, ‘শরীরের ১৫ ভাগ আগুনে পুড়েছে। প্রথমে কথা বলতে না পারলেও এখন বলতে পারে। সন্তানদের বার বার দেখতে চায়। কিন্তু চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসতে চাই না। ছেলে একটু বড়। দশম শ্রেণীতে পড়ে। মেয়েটা পড়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে। ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে আসলেও মেয়েকে একবারের জন্যও আনিনি। সে বাবার চেহারা দেখে সহ্য করতে পারবে না, ভয় পাবে।’
মাসুমা বেগম জীবন সংগ্রামের এ সব গল্প বলার সময় চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘কত হাসি খুশি ছিল মানুষটা। এখন সব সময় আতঙ্কে থাকেন। ছেলেমেয়েরা বাইরে আছে কিনা, তা নিয়েও উৎকণ্ঠায় থাকেন।’
মাসুমা বেগম বলে চলেন নানা স্বপ্নের কথা। তিনি বলেন, ‘কত স্বপ্ন ছিল মানুষটার। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে। এই জন্য কত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করত। কিন্তু এখনতো সব স্বপ্ন পুড়ে গেছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কিনা, এ নিয়েই শঙ্কায় আছি।’
শরীফ খানের পাশের বিছানায় শুয়ে আছেন যাত্রাবাড়ীর ঘটনায় আরেক অগ্নিদগ্ধ মো. সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিনের স্ত্রী উর্মি আক্তার স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। উর্মি আক্তার জানান, অধিকাংশ সময়ই শরীরে প্রচণ্ড জ্বর আসে। এতে কাঁপতে থাকেন (সালাউদ্দিন)। জড়িয়ে ধরে রাখলে কাঁপাকাঁপি একটু কমে।
তিনি বলেন, ‘যা ঘটার তা ঘটে গেছে। এ নিয়ে আর চিন্তা করছি না। এখন একটাই চিন্তা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে তো।’
শুধু শরীফ খান ও সালাউদ্দিনই নয়, আগুনে পোড়া সব রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া নিয়েই শঙ্কা রয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কারণে তাদের শরীরে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা। ফলে তাদের মধ্যে যে মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সমস্যা হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা ডা. সামন্ত লাল সেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অগ্নিদগ্ধ রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে একটু সমস্যাতো হবেই। এক্ষেত্রে তাদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসারও প্রয়োজন রয়েছে। আমরা সেই ব্যবস্থাও করছি। প্রতিদিনই এ সব রোগীদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা দিচ্ছি। তার পরও তাদের কিছু সমস্যা থেকে যাবে।’
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা। এই পরিস্থিতিতে বার্ন ইউনিটে দর্শনার্থীদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই আসছে ভিভিআইপি ও ভিআইপি দর্শনার্থী। এদের সঙ্গে থাকছেন আরও অনেক সঙ্গী। এতে করে বার্ন ইউনিটে সংক্রামক ঝুঁকি বাড়ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ সঙ্কর পাল , ‘বার্নের রোগীদের শরীরের চামড়া পুড়ে যাওয়ার কারণে সংক্রামক ঝুঁকি অনেক বেশী। তাই বার্ন ইউনিটে দর্শনার্থীদের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু তার পরও দর্শনার্থীতো আসেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভিভিআইপিদের সঙ্গে যারা আসেন, তারা অল্প সময় থাকেন। এখন তাদের চাপ কমে গেছে। তবে রোগীর চাপ বেড়েছে।’
বার্ন ইউনিটের উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘অতিরিক্ত রোগীর চাপে চিকিৎসাক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট সহায়তা করছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend