মৃত ঘোড়া সমাচার -মুহম্মদ জাফর ইকবাল

zafar+iqbal-350x217আমি যখন খুব ছোট, তখন একদিন আমার বাবা আমার হাত দেখে বলেছিলেন, তুই আশি বছর বাঁচবি। শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, কী সর্বনাশ, মাত্র আশি বছর! মনে আছে মনের দুঃখে সারারাত আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলাম এবং নানাভাবে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করতে হয়েছিল। যা হোক এখন আমার বয়স বাষট্টি এবং আমি জানি বেঁচে থাকার জন্য আশি বছর অনেক, আমার কপালে সেটা জুটবে কিনা জানি না (যখনই কোনো জঙ্গি বাহিনীর খুন করার তালিকা উদ্ধার করা হয় সেখানে আমার নামটি থাকে!)।

যদি সত্যি সত্যি আশি বছর বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে একটা নতুন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারব সেটা চিন্তা করে আজকাল আমি এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করি।
সেই শৈশব থেকে আমাদের দেশটি কত বড় হতভাগা, শুধু সেই কথাটিই শুনে এসেছি। যে দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে ছিলাম তখন একটিবারও দেশ সম্পর্কে ভালো কিছু শুনিনি, সে দেশের যে কোনো সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ শব্দটি লেখা হলে সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া হতো, এটি বন্যা-ঘূর্ণিঝড়-দুর্ভিক্ষ-দুর্নীতি-দরিদ্রতার দেশ। আমি যখন দেশে ফিরে এসেছি আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল, এখন কেউ আর আমার দেশের নামটি শুনে আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাবে না। আমার চোখের সামনে খুব ধীরে ধীরে আমাদের দুঃখী দেশটি একটি হাসিখুশি দেশে পাল্টে যাচ্ছে (যারা সেটি দেখতে পায় না, এখন আমি তাদের জন্য করুণা অনুভব করি)।

এক সপ্তাহ আগে একজন আন্তর্জাতিক গবেষকের একটা লেখা পড়ছিলাম যে, বাংলাশের সমুদ্রের নিচে সম্ভবত ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস রয়েছে। যদি সেটি ঠিক করে তোলা যায় তাহলে এ দেশটি পৃথিবীর গ্যাস সরবরাহকারী সবচেয়ে বড় একটি দেশ হয়ে যাবে।
আমি যখন এ লেখাটি পড়ছিলাম তখন আমার মনে হয়েছে সত্যি সত্যি এ গ্যাস আছে কিনা, কেউ এখনও নিশ্চিত নয়, এ গ্যাস তোলা যাবে কিনা সেটাও কেউ ভালো করে জানে না; কিন্তু বাংলাদেশের অন্য বিশাল যে একটি সম্পদ রয়েছে এবং যে সম্পদ নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই, সেটি যে আমাদের গ্যাসসম্পদ থেকে অনেক বেশি মূল্যবান তা কেমন করে ভুলে যাচ্ছি?
সেই সম্পদ হচ্ছে, আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা। এ দেশে তিন কোটি শিশু-কিশোর স্কুলের ছাত্রছাত্রী, পৃথিবীর শতকরা আশি ভাগ দেশে তিন কোটি মানুষই নেই! স্কুলের এ বিশাল সংখ্যার ছেলেমেয়েকে যদি আমরা লেখাপড়া শেখাতে পারি, তাহলে এ দেশে যে কী অসাধারণ একটা ম্যাজিক ঘটে যাবে সেটা কি কেউ কল্পনা করতে পারবে? নতুন সহস্রাব্দে তেল-গ্যাস-কলকারখানা কিন্তু সম্পদ নয়, নতুন সহস্রাব্দে সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। আর সেই জ্ঞানটা তৈরি করতে, জমা করতে, বাড়িয়ে তুলতে দরকার মানুষ- আরও ঠিক করে বললে বলতে হয় ছাত্রছাত্রী। কাজেই আমাদের যে কী বিশাল একটা সম্ভাবনা একেবারে দরজায় কড়া নাড়ছে সেটি কি সবাই জানে?
শুধু কি তাই? আমাদের এ ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছেলে আর মেয়ের সংখ্যা সমান সমান। লেখাপড়া জানা এ মেয়েরা যখন ছেলেদের পাশাপাশি সব জায়গায় কাজ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে, নেতৃত্ব দেবে তখন যে বিপ্লবটা ঘটবে, সেটা কি কেউ অনুভব করতে পারছে?
আমরা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করি, জঙ্গি বাহিনী নিয়ে দুর্ভাবনা করি, একটা শিক্ষিত মা কি কখনও তার সন্তানকে নারীবিদ্বেষী, ধর্মান্ধ জঙ্গি দেশদ্রোহী হতে দেবে? দেবে না।
কাজেই দেশের অনেক মানুষ যখন নানা ধরনের দুশ্চিন্তায় হতাশাগ্রস্ত হয়, আমি তখন ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াই। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কোনো দুর্ভাবনা নেই।
২.
লেখাপড়া নিয়ে আমার এক ধরনের আগ্রহ আছে, কৌতূহল আছে। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের ঠিক করে লেখাপড়া শেখানো চারটিখানি কথা নয় (সব স্কুলে একটা করে চক দিতে হলেই ৮০ হাজার চক কিনতে হবে!)।

সরকার এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এত কম টাকা দেয় যে, সবকিছু গুছিয়ে করা সম্ভব নয়। তারপরও কাজটা খুব কঠিন তা আমার একবারও মনে হয় না। একটা উদাহরণ দিই :
আমাদের দেশে লেখাপড়ার মাঝে পরীক্ষার গুরুত্ব বেশি। এ দেশের ছেলেমেয়েরা যেটুকু, তার চেয়ে তাদের বাবা-মায়েরা জিপিএ ফাইভের জন্য অনেক বেশি পাগল! পৃথিবীতে যতদিন পরীক্ষা থাকবে ছাত্রছাত্রীরা ততদিন পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চাইবে। শুধু এ ব্যাপারটা মনে রাখলেই লেখাপড়াকে অনেকটুকু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যেহেতু সবাই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চায় তাই পরীক্ষাটা হতে হবে অসম্ভব কৌশলী একটা পরীক্ষা। যেন পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের চেষ্টাতেই ঠিক ঠিক লেখাপড়া করতে পারে।
এখানে এ মুহূর্তে আমরা মার খেয়ে যাচ্ছি। সৃজনশীল পরীক্ষা ছিল তার প্রথম ধাপ; কিন্তু আমি আবিষ্কার করেছি আমাদের শিক্ষকরা এখনও ভালো সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না। সেই সুযোগে সৃজনশীল গাইড বই বেরিয়ে গেছে, অনেক শিক্ষক সেটি ব্যবহার করছেন এবং যেখানে এটা ব্যবহার হয়েছে সেখানে সৃজনশীল পরীক্ষার সত্যিকারের উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি মাঠে মারা গেছে। আমি ঠিক করেছি আমার সহকর্মীদের নিয়ে একটা উদ্যোগ নেব এবং সারা পৃথিবীর উৎসাহী বাংলাদেশী তরুণদের সাহায্য নিয়ে এ দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য অসংখ্য অসাধারণ সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করার ব্যবস্থা করে দেব (যারা সাহায্য করতে চায় তাদের জন্য বলছি এর কাজ চলছে সময় হলেই Crowd sourcing-এর জন্য ডাক দেয়া হবে)।
ভালো প্রশ্ন না হয়ে সাদামাটা প্রশ্ন একটা বড় সমস্যা ছিল, এখন অন্যান্য সমস্যার তুলনায় এ সমস্যাটাকে অনেক ছোট সমস্যা মনে হচ্ছে। যেহেতু এ দেশের প্রায় সব মানুষের ছেলেমেয়েরাই আজকাল স্কুলে লেখাপড়া করে তাই সবাই ব্যাপারগুলো জানে। একটা হচ্ছে, পাইকারিভাবে সবাইকে পাস করিয়ে দেয়া- এতে পাস করার সংখ্যাটা বাড়ে; কিন্তু লেখাপড়া তো বাড়ে না। আমরা সবাই প্রায় একই রকম আরেকটা ব্যাপার দেখেছি। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাল্যবিয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনবে, এর জন্য যে বুদ্ধি বের করেছে এরকম ফিচলে বুদ্ধি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি! হঠাৎ করে শুনতে পেলাম মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬-তে কমিয়ে আনবে। তাহলে রাতারাতি এ দেশে বাল্যবিয়ের সংখ্যা নেমে আসত, কারণ ১৬ থেকে ১৮ বছরের যে মেয়েদের বিয়ে হতো তারা আর বাল্যবিয়ের হিসাবে আসত না! আমরা জানি সম্ভবত এ বয়সেই এ দেশে সবচেয়ে বেশি বিয়ে দেয়া হয়, এক কলমের খোঁচায় তাদের বিয়েটাকে বাল্যবিয়ের বাইরে ঠেলে নিতে পারলে পরিসংখ্যান চোখের পলকে সম্মানজনক হয়ে উঠত। মোটামুটি একই কায়দায় পাসের হার বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং দেখতে দেখতে আমরা দুটি ভয়ংকর ব্যাপার দেখতে পেয়েছি : (এক) পরীক্ষার খাতায় দুই হাতে নম্বর দেয়া শুরু হয়েছে, (দুই) পরীক্ষার হলে ছেলেমেয়েরা দেখাদেখি শুরু করেছে, শিক্ষকরা শুধু যে সেটা না দেখার ভান করছেন তা নয়, নিজেরাই প্রশ্নের উত্তর লিখে ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। আমি জানি আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটা অস্বীকার করবে, এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করবে, সরকারের অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার হীন ষড়যন্ত্র বলবে; কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। এ দেশের প্রায় প্রত্যেকের ঘরে স্কুলে যাওয়া ছেলেমেয়ে আছে, এ দেশের প্রত্যেকে এটা জানে।
এ দুটি ব্যাপারের পাশাপাশি আরও একটি ঘটনা ঘটে চলেছে, সেটি হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। এ প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করার জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া বা ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনার কথা শুনে আমরা বুঝতে পারছি আসলে মন্ত্রী মহোদয় প্রশ্ন ফাঁসের আসল বিষয়টিই এখনও ধরতে পারেননি। মোবাইল ফোন বা ফেসবুক ব্যবহার করা হয় ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন বিতরণ করার জন্য, যদি প্রশ্নটি ফাঁস না হয় তাহলে এটা কেউ বিতরণ করতে পারে না। প্রশ্নটি ফাঁস হয় শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কারণে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আমি অনেক চিৎকার করেছি, এভাবে চিৎকার করতে ভালো লাগে না। এবারে পিএসসি প্রশ্ন ফাঁসের পর সবাই চিৎকার শুরু করেছে। আশা করছি এবারে হয়তো বিষয়টার একটা নিষ্পত্তি হবে। যদি না হয় তাহলে সবাইকে নিয়ে পথে নেমে আসা ছাড়া আমাদের আর কিছু উপায় থাকবে না।
কীভাবে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয় আমি তার খোঁজ নিয়েছি। এখানে অনেকগুলো ধাপ এবং প্রত্যেকটা ধাপ থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। যেমন একটা দল প্রশ্ন করেন, অন্য একটা দল প্রশ্ন সমন্বয় করেন, অন্য আরেকটা দল প্রশ্ন টাইপ করেন, অন্য আরেকটা দল প্র“ফ দেখেন, অন্য আরেকটা দল প্রশ্ন ছাপান, অন্য দল প্রশ্ন প্যাকেট করেন, অন্য আরেকটা দল বিতরণ করেন। কাজেই এ পদ্ধতিটা যতক্ষণ পর্যন্ত পাল্টে না দেয়া হচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকি থেকেই যায়।
এর বাইরে আরও একটা ব্যাপার আছে, পাবলিক পরীক্ষার এ প্রশ্নগুলোতে পরীক্ষা দেয় লাখ লাখ ছেলেমেয়ে। যে প্রশ্নে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দেয় তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কী হতে পারে? কাজেই যারা এ প্রশ্ন করেন, সমন্বয় করেন তাদের কি ঠিক তার সমান গুরুত্ব দিতে হবে না? কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয়া হয় না, শুনেছি সাত-আটশ থেকে হাজারখানেক টাকা সম্মানী দেয়া হয়। গতবার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর তদন্ত কমিটি আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, যারা প্রশ্ন করবেন তাদের জন্য হোটেল সোনারগাঁওয়ের একটা ফ্লোর ভাড়া করে সেখানে সবাইকে সপ্তাহখানেক বা সপ্তাহ দুয়েক রেখে দিতে। যেন তারা নিশ্চিন্তভাবে পুরো সময়টা থেকে চমৎকার প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন, তারা ভেবেছিলেন আমি ঠাট্টা করছি- আমি কিন্তু একেবারেই ঠাট্টা করিনি। আমলারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করবেন; কিন্তু শিক্ষকদের জন্য এক পয়সাও খরচ করতে রাজি নন!
৩.
লেখাপড়ার জন্য পরীক্ষার পরের বিষয়টা হচ্ছে ভালো পাঠ্যবই- আসলে বলা উচিত খু-উ-ব ভালো পাঠ্যবই। খুব ভালো পরীক্ষা নিতে যেমন বাড়তি টাকা লাগে না, ঠিক সে রকম খুব ভালো পাঠ্যবই তৈরি করতেও আসলে খুব বেশি বাড়তি টাকা লাগে না। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন এ দেশের ছেলেমেয়েরা কেউ প্রাইভেট পড়ত না, কোচিং শব্দটার তখনও জন্মও হয়নি। যদি বা কখনও কাউকে প্রাইভেট পড়তে হতো, সেই কাজটাও করা হতো খুবই প্রাইভেটভাবে অর্থাৎ খুবই গোপনে, কারণ এটাকে মোটেও সম্মানজনক ভাবা হতো না। স্কুলে স্যাররা যদি ভালো না হতেন, তাহলে নিজেদেরই বইটা ভালো করে পড়তে হতো।
কাজেই বইটা যদি ভালো হয়, তাহলে পরিশ্রমী ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল, ভালো শিক্ষকের অভাবটুকু ভালো পাঠ্যবই দিয়ে পূরণ করে নিতে পারে। ভালো বই বলতে কী বোঝানো হয়, সেটা দেখার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ইংরেজি মিডিয়াম (ও লেভেল, এ লেভেল) স্কুলের পাঠ্যবইগুলো একবার তুলনা করতে বলব। আমাদের দেশের শিক্ষাবিদদের ওরকম বই লেখার ক্ষমতা নেই আমি সেটা একবারও বলছি না, অবশ্যই আছে। কিন্তু আসলে সেভাবে উদ্যোগটা নেয়া হয় না। আজকাল জাতীয় পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া যায় সেই বইগুলো দেখলে চোখে পানি এসে যায়, এত অযত্নে বইগুলো তৈরি করা হয়েছে যে অবাক হয়ে যেতে হয়। এইচএসসির নতুন সিলেবাসে নতুন বই বের হয়েছে কিন্তু যার সঙ্গে কথা বলি সেই আমাকে জানায় নতুন সিলেবাসে বইটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যে বিষয়টা বুঝতে হলে আগের বইগুলো পড়তে হয়। তাহলে নতুন বই নিয়ে লাভ কী হল!
যারা দুর্বল ছাত্র, আত্মবিশ্বাসহীন ছাত্র, তারা সম্ভবত আরও কিছুদিন প্রাইভেট পড়বে, কোচিং পড়বে কিন্তু যদি অসাধারণ কিছু পাঠ্যবই থাকে তাহলে দেশের অনেক পরিশ্রমী ছেলেমেয়ে হয়তো এ পাঠ্যবই পড়েই লেখাপড়া করে ফেলতে পারবে। স্কুলে ভালো শিক্ষক না থাকলেও একটা ভালো পাঠ্যবই দিয়ে পরিশ্রমী ছেলেমেয়েরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে!
তবে পাঠ্যবই নিয়ে কথা বলতে হলে আমি সব সময়েই এক জায়গায় এসে খুব আনন্দ পাই, সেটি হচ্ছে বছরের শুরুতে সব ছাত্রছাত্রীর হাতে নতুন বই তুলে দেয়া। প্রতি বছর যে পরিমাণ পাঠ্যবই ছাপানো হয়, আমি হিসাব করে দেখেছি সেগুলো একটার পর আরেকটা বসানো হলে পুরো পৃথিবীটা তিনবার পাক খেয়ে আসবে! ছোট ছোট শিশু-কিশোর যখন তাদের নতুন বইগুলো বুকে চেপে ধরে হাসিমুখে বাসার দিকে যায়, তার থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না।
৪.
ভালো লেখাপড়ার জন্য ভালো পরীক্ষা আর ভালো পাঠ্যবইয়ের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু এখনও সবচেয়ে জরুরি বিষয়টার কথা বলা হয়নি। সেটি হচ্ছে ভালো শিক্ষক। যখনই আমি একটা ভালো স্কুলের কথা শুনি তখনই আমি জানি নিশ্চয়ই সেখানে ভালো শিক্ষক আছেন। যে ছাত্রছাত্রীরা তাদের জীবনে একজন ভালো শিক্ষক পেয়েছে, তার জীবনে একটুখানি হলেও পরিবর্তন হয়েছে।
ভালো একটা পরীক্ষা কিংবা খুব ভালো কিছু পাঠ্যবই ইচ্ছা করলেই পাওয়া সম্ভব; কিন্তু ভালো শিক্ষকের বেলায় সেটি সত্যি নয়। আমরা চাইলেই রাতারাতি দেশের সব স্কুলের জন্য ভালো ভালো শিক্ষক হাজির করতে পারব না।
আশা করে আছি শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হবে এবং সেই স্কেলটা এত লোভনীয় হবে যে, দেশের সেরা ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহ নিয়ে শিক্ষক হবে। শুধু বেতন স্কেল নয়, আমি আশা করছি পাশাপাশি তাদের সম্মানটুকুও দেয়া হবে। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, প্রাইমারি স্কুলের সাধারণ শিক্ষকরা এ দেশে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী! একজন শিক্ষককে আমরা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী বলব, এটা কীভাবে সম্ভব?
৫.
জোট সরকার সরে যাওয়ার পর এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটা বেশ ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে বিষয়গুলো সরিয়ে দেয়া হয়েছিল সেগুলো ঠিকভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। শিক্ষানীতি করা হয়েছিল, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল- সব মিলিয়ে দেশে শিক্ষা নিয়ে একটা উৎসাহের ভাব ছিল। যখনই জরিপ করা হতো দেখা যেত জনপ্রিয়তার শীর্ষে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী। আমি নিজেও পুরো বিষয়টা নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলাম।
তারপর ধীরে ধীরে কোথায় জানি এ গোলমালটা শুরু হয়েছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে পুরো লেখাপড়ার বিষয়টিতে একটা গোঁজামিল দেয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষানীতিতে নেই তারপরও এ দেশের ছেলেমেয়েদের ওপর জোর করে বাড়তি পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে (সে জন্য দিনরাত সবার কাছে গালাগাল শুনি, ছোট ছোট শিশু ও তাদের বাবা-মায়েরা আমাকে অভিশাপ দেন)।

যদি এটা অনেক সুফল নিয়ে আসত তাহলে কেউ কিছু বলত না, সবাই মেনে নিত।
কিন্তু তা ঘটেনি। বাড়তি পরীক্ষার চাপে ছোট ছোট শিশুদের জীবনের সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে, কোথাও কোথাও শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্নের উত্তর ছাত্রছাত্রীদের পৌঁছে দিচ্ছেন। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর শিক্ষক-অভিভাবকরা সমান উৎসাহে সেই প্রশ্ন বের করে তাদের ছাত্রছাত্রী কিংবা সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। শিশুরা অবাক হয়ে দেখছে তাদের শিক্ষকরা কিংবা তাদের বাবা-মায়েরা এক ধরনের অসৎ মানুষ। সেই শিক্ষক কিংবা বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সামনে কেমন করে মুখ দেখান?
আমি যখন পিএইচডি করছিলাম, তখন আমাদের মাথায় নানা ধরনের আইডিয়া কাজ করত। গবেষণা করতে করতে আমরা সবাই নিজেদের সেসব আইডিয়া কাজে লাগানোর চেষ্টা করতাম, কোনো কোনো আইডিয়া কাজ করত, কোনো কোনোটা করত না। আমার প্রফেসর তখন আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যা আমি সারা জীবন মনে রেখেছি। আমাকে বলেছিলেন, তোমার আইডিয়া হচ্ছে একটা ঘোড়ার মতন, যতক্ষণ লাফঝাঁপ দিচ্ছে সেটা নিয়ে নাচানাচি করো- সমস্যা নেই। কিন্তু যদি দেখ ঘোড়া মরে গেছে, খবরদার ওটাকে নিয়ে টানাটানি করো না, যত তাড়াতাড়ি পার ওটাকে কবর দেবে!
আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির কিছু কিছু ঘোড়া (পিএসসি পরীক্ষা, জেএসসি পরীক্ষা) মরে গেছে, শুধু তাই নয়, মৃতদেহ থেকে রীতিমতো দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব এগুলোকে কবর দিতে হবে।
০২.১২.১৪
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; লেখক

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend