বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আর নেই

kayyum-chyরোববার ৩০ নভেম্বর রাত পৌনে ৯টার দিকে আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ দিনে বক্তৃতা রাখার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হলে তাঁর মৃত্যু হয়।
জন্ম এবং পরিবার

কাইয়ুম চৌধুরী জন্মেছিলেন ফেনীতে, ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ। ক্ষয়িঞ্চু যে জমিদার-পরিবারে তাঁর জন্ম সেখানে বিত্তের পূর্বতন জৌলুস বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না, কিন্তু এই পরিবারে শিক্ষা ও উদার মানসের ছিল জোরদার অবস্থান। পিতা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় পরিদর্শক এবং পরে হয়েছিলেন সমবায় ব্যাংকের কর্মকর্তা।

শিক্ষাজীবন
একেবারে বাল্যে মক্তবে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি, তারপর ভর্তি হলেন চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। এরপর কিছুকাল কুমিল্লায় কাটিয়ে চলে যান নড়াইলে। চিত্রা পারের এই শান্ত স্নিগ্ধশ্রী শহরে কাটে তাঁর বাল্যের তিনটি বছর। সেখান থেকে সন্দ্বীপ এসে ভর্তি হন প্রথমে সন্দ্বীপ হাই স্কুলে ও পরে কারগিল হাই স্কুলে। পুত্রকে আরবি ভাষায় সবক ও নামাজ শিক্ষাদানের জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন গৃহশিক্ষক, যিনি সন্দ্বীপ হাই স্কুলের মৌলবি স্যার। পরে স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় বালকের স্মৃতি ঐশ্বর্য মণ্ডিত করে আরবি স্যার হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইলেন অতুলপ্রসাদের গান, ‘সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।’ এরপর নোয়াখালি সদরে কিছুকাল কাটিয়ে পিতার সঙ্গে তাঁর ঠাঁই বদল হয় ফেনীতে। ভর্তি হলেন ফেনী হাই স্কুলে, সেখানে থেকে যান ফরিদপুরে। ফরিদপুর থেকে অবশেষে ময়মনসিংহ এসে সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে যখন ম্যাট্রিক পাশ করেন তখন ১৯৪৯ সাল, বৃটিশ বিদায় হয়ে পাকিস্তানের জন্মের পর কেটেছে প্রায় দু’বছর। ১৯৪৯ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে কাইয়ুম চৌধুরী কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ সালে।

কর্মজীবন
১৯৫৪ সালে কাইয়ুম চৌধুরী যখন ফাইন আর্টস বিভাগের পাঠ সমাপন করলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি। পাশ করার পর কাইয়ুম চৌধুরী তক্ষনি কোনও পেশায় যোগ দেননি। ১৯৫৫-৫৬ সালে তিনি নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ করেছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, আর করেছেন বইয়ের প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের কাজ। তবে প্রচ্ছদ অঙ্কনে তাঁর সুবিধা ছিল তাঁর পঠনপাঠন ও সাহিত্যবোধের ব্যাপ্তি, বইয়ের অন্তর্নিহিত ভাব অবলম্বন করে তিনি পৌঁছতে পারেন বহিরঙ্গে। বইয়ের প্রচ্ছদকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার ক্ষেত্রে সত্যজিত্‍ রায়ের শৈল্পিক স্পর্শ তখন পল্লবিত হতে শুরু করেছে সিগনেট প্রেসের প্রকাশনাকে ঘিরে। পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে সত্যজিত্‍ রায় সিগনেটের প্রকাশনার শিল্পনির্দেশনার কাজ শুরু করেন এবং কেবল প্রচ্ছদ অঙ্কনই নয়, পেছনের মলাটের লিপিবিন্যাস, নামপত্র, পৃষ্টাসজ্জা, বাঁধাই ইত্যাদি মিলিয়ে প্রকাশনাকে একটি সামগ্রিক শিল্পরুচির বাহক করে তোলেন। ঢাকায় সিগনেটের বই মোটামুটিভাবে ছিল লভ্য। কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য এ ছিল এক অনুপম নিদর্শন। তবে পূর্ববঙ্গে প্রকাশনার তখন সবে সূচনাকাল, পাঠ্যবইয়ের বাইরের সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা যেমন কম তেমনি মুদ্রণ পদ্ধতি ও রঙ্গিন প্রচ্ছদ ছাপার রীতিও একান্ত সেকেলে। ধীরে ধীরে সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছিল এবং চুয়ান্নর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়ে যুক্তফ্রন্টের বিজয় এ উত্‍সাহব্যঞ্জক অবস্থার জন্ম দিয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণ বাংলা সাহিত্য ও প্রকাশনায় প্রেরণা যোগাচ্ছিল। সাময়িক পত্রিকা বিষয়ে আগ্রহী কাইয়ুম চৌধুরী, ‘ছায়াছবি’ নামে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকী যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছিলেন কিছুকাল। সুযোগমতো টুকটাক প্রচ্ছদ আঁকছিলেন এবং এই কাজের সূত্রেই পরিচয় সৈয়দ শামছুল হকের সঙ্গে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend