পালাবদলের কাল আর কত প্রলম্বিত হবে? -আবুল মোমেন

e5cff8925477e7321e28d7ef7f243538-1পালাবদলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মানুষই এই বদলের মূল কারিগর। দুই দশক ধরে এই ধারা চললেও ক্ষমতার রাজনীতির ডামাডোলে, দুর্নীতির ব্যাপকতায় এবং মারাত্মক অপরাধের তোলপাড়ে তা সবার চোখে পড়ে। কিন্তু গত পাঁচ থেকে সাত বছরে রাজনীতি-দুর্নীতি-অপরাধচিত্র একই রকম থাকা সত্ত্বেও পালাবদলের বিষয়টি আর চোখ এড়াচ্ছে না। শিক্ষার বিস্তৃতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতাবৃদ্ধি, প্রযুক্তির প্রভাব এবং নগর ও নাগরিক জীবনাচারের বিস্তার—মোটামুটি এই চারটি ক্ষেত্র নাগরিকদের জীবনে গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে। হয়তো তার সঙ্গে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া মুক্তবাজারব্যবস্থার প্রভাবও রয়েছে। এ পরিবর্তন ইতিবাচক এবং তার পেছনে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, উদ্যম ও অংশগ্রহণই মূল বিষয় হওয়ায় সমাজে চলমান সংঘবদ্ধ নেতিবাচক প্রবণতাগুলোর কাছে তা হার মানেনি—হয়তো সাফল্য কিছুটা কমেছে।
সমাজের এই পালাবদলের সময়কে বলা যায় ব্যক্তির বৈষয়িকভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার কাল। এ মানসিকতার ভেতরে কিন্তু একটা সর্বনাশা চোরাস্রোতও কাজ করে। ভাগ্যোন্নয়নের দৌড়ে ব্যতিব্যস্ত মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে; যদি-না সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে সামলায়। এখানেই আমরা হোঁচট খাচ্ছি। অতি লোভে সোনার ডিম-পাড়া হাঁসকে মারার মতোই এখানে বেপরোয়া লোভে পড়ে সব প্রতিষ্ঠানকেই ধ্বংস করা হচ্ছে। আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানই আজ স্বচরিত্রে স্বমহিমায় কার্যকর নেই। ক্ষমতার রাজনীতির আশ্রয়ে থেকে দুর্নীতির সহায়তা নিয়ে অপরাধে যুক্ত হয়ে অতি লোভ ঠিকই সব প্রতিষ্ঠানকে অকেজো করে চরিতার্থ হয়ে চলেছে। এমন একটা রসায়ন সমাজে চলছে, যা ক্ষমতাবান ও বিত্তবানের জন্য পক্ষপাত তৈরি করছে। সবার পক্ষে বড় ধনী ও বড় ক্ষমতাবান হওয়া হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু যেহেতু বর্তমান বাস্তবতায় ধনী হলে ক্ষমতাবান হওয়া যায় বা ক্ষমতাবানমাত্রই ধনী, তাই ভাগ্যোন্নয়নে মরিয়া মানুষমাত্রই ক্ষমতাবান ধনী হতে চান, নয়তো নিদেনপক্ষে এসব ধনী ক্ষমতাবানের আশ্রয়পুষ্ট হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। এ প্রতিযোগিতায় আপসের স্থান নেই, তাই প্রায়ই হিংস্র পন্থায় স্বার্থের দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। যে রাজনীতি প্রয়োজনে হিংসাত্মক ঘটনাগুলো আড়াল করে কিংবা প্রকাশ করে তা অবশ্যই ক্ষমতা ও বিত্তেরই সৃষ্ট। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে মূল রাজনীতি এই ঘূর্ণাবর্তেই হাবুডুবু খাচ্ছে।
এ প্রক্রিয়া খানিকটা বাঘের পিঠে চড়ার মতো। ক্ষুধার্ত ছুটন্ত বাঘ ক্ষমতা ও বিত্তের উপযুক্ত প্রতীক হতে পারে। ক্ষমতা ও বিত্ত কেবল নেশা নয়, তা নিত্যনতুন প্রয়োজন তৈরি করে নিতে পারে, বস্তুত এদের উদয়াস্ত ছুটে চলার পেছনে এটাই মূল প্রণোদনা। নয়তো কাজটা যথেষ্ট পরিশ্রমের এবং মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিশ্রম ও ঝুঁকির ধকল ভাগ্যান্বেষীরা যেচেই নিচ্ছেন। এটাই তাঁদের জীবন। এখানে উত্তেজনা, সাসপেন্স, জিঘাংসা, উপভোগ্যতা, চরিতার্থতা, সন্তোষ—সবই অত্যন্ত প্রকটভাবে উপস্থিত। জীবন বেশ চটকদার নাটকীয়তায় সরব ও সরগরম—তাতে তাঁদের বেঁচে থাকার বোধ জীবন্ত থাকে। এই সুবাদে লঘুচালে একটা কথা বলা যায়। উন্নয়নের নির্মাণ অংশ বরাবর সশব্দ, কোলাহলময়, চমকপ্রদ তো বটেই এমনকি চটকদারও হতে পারে। সব মিলে অবশ্যই জীবন্ত ও বেশ নাটকীয়ও। কিন্তু উন্নয়নের একটি পরিণত দিক আছে, যেটি সুসম্পন্ন হলে তৃপ্তিদায়ক, স্বস্তিদায়ক। মানুষ কেবল বিত্ত অর্জনেই প্রাণপাত করলে প্রশ্ন উঠবে, মানবজীবনের তাৎপর্যের কী হবে।
ফলে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে জীবন কাটবে না—পিঠ থেকে পেটে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। অনেক সওয়ারিকেই এভাবে সাবাড় হতে দেখেছি আমরা। বোধ হয় এবার সময় হয়েছে নামার। নয়তো সাধারণ মানুষের এত অর্জন সত্ত্বেও, এবং পরিসংখ্যানে ও বাস্তবেও বস্তুগত উন্নতি থেমে না থাকলেও, জীবন স্বস্তিদায়ক হবে না। স্বাভাবিক মানবজীবনের তৃপ্তি পাওয়া যাবে না। আফসোস আর দীর্ঘশ্বাস বাড়বে নানা কারণে। এখন এমনটাই আমাদের বাস্তবতা। ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র—এ সমাজে কেউ স্বস্তিতে নেই।
এ অনেকটা পেটরোগা মানুষের মতো, অনেক কিছুই খায় কিন্তু স্বাস্থ্য ফেরে না। বাংলাদেশের মানুষ অনেক কিছু অর্জন করছে কিন্তু সমাজের স্বাস্থ্য ফিরছে না, লাবণ্য-শ্রী তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষা ও রাজনীতি যে দুটি ক্ষেত্র থেকে সংশোধন, পরিমার্জন ও পুনর্গঠনের রসদ আসতে পারত, সেগুলো তা জোগান দিতে পারছে না। গণমানুষের শিক্ষা গ্রহণের এ দুটিই মূল বীজতলা। আমরা রাজনীতি প্রায় নষ্ট করেছি, আর শিক্ষা-বীজতলায় বপন ঠিক হচ্ছে না। আপাতত ফলাফল একই রকম মনে হলেও পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের শিক্ষা এখনো কেতাবি, পরীক্ষামুখী হওয়ায় লেখাপড়ার জীবনমুখী হওয়ার অবসর মিলছে না। বরং পরীক্ষার চাপে বেশি করে কেতাবি গণ্ডিতে বাঁধা পড়ছে। ফলে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জীবনগঠনের রসদ মিলছে না; তা আসছে চাষাভুষার (তুচ্ছার্থে নয়, বাস্তব হিসেবে) মতো এলোমেলো ১০ জায়গা থেকে। ফলে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরও পরিচ্ছন্ন চিন্তা, মননের শৃঙ্খলা, পরিমার্জিত রুচি নিশ্চিত হচ্ছে না। সমাজমানস অপরিচ্ছন্ন ও অপরিণত থেকে যাচ্ছে। এটা একটা বড় দুর্বলতা এ সমাজের। শিক্ষার কর্তাব্যক্তিরা কেবল বোঝেন ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দৃষ্টিগ্রাহ্য সাফল্য দেখাতে হবে। আর তা সহজে দেখানো যায় পরিমাণগত অর্জনের ছকের মাধ্যমে। এদিকে পরিমাণগত সাফল্য থেকে গুণগত সাফল্যের পথে সরে আসার মধ্যে তাঁরা ঝুঁকি বোধ করেন। কারণ, এ ক্ষেত্রে দ্রুত, অন্তত সাময়িকভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য, এমন কোনো নজির তুলে ধরা সম্ভব নয়, যা জনসাধারণকে সরকারের সাফল্য সম্পর্কে মোক্ষম ধারণা দেবে। ফলে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের পক্ষে যথেষ্ট সাফাই গাওয়া হলেও কাজের কাজ হতে পারছে না।
গুণগত পরিবর্তন আসলেই একটি বড় ধরনের কাজ। নিজেদের বহুকালের অভ্যাস ও অভ্যস্ততা বদলানো তত সহজ নয়। বিষয় ও লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছাড়া এটা সম্ভবও নয়। লক্ষ্য নিয়ে আন্তরিক হতে হবে, শতভাগ অঙ্গীকার নিয়ে কাজটা করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে বলে মনে হয়।
রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে, এবং এ ক্ষেত্রেও কাজটা সহজ নয়। তবে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের একটা আবশ্যিক শর্ত হলো পরিমাণগত পরিবর্তন। বর্তমান গুণহীন রাজনীতির প্রধান দোষ হলো তা জনগণের অধিকাংশকে ধারণ করে না, মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানের কবজায় বন্দী। রাজনীতিতে সবার বা অধিকাংশের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে মুষ্টিমেয় মানুষের হাত থেকে তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার মধ্যেই এর গুণগত পরিবর্তন নিহিত আছে। বিপরীতে শিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণের অধিকার নিশ্চিত করেও ব্যক্তিমানুষের গুণগত সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই শিক্ষার প্রকৃত গুণগত মান্নোয়ন ঘটবে।
কীভাবে রাজনীতির এই যুগপৎ পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন সম্ভব? সেটা শুরু করতে হবে নিচে থেকে। বলা যায়, স্থানীয় সরকার থেকেই শুরু করা ভালো। আর বড় দলের স্থানীয় কমিটিগুলো গঠনের ক্ষেত্রে মূল নেত্রী বা তাঁর প্রতিনিধিদের মুখাপেক্ষিতা বাদ দিয়ে সাধারণ সদস্যদের ওপর নির্ভর করেও শুরু করা যায়। চমৎকার সূচনা হতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ গঠন শুরু করে। প্রথম দিকে হয়তো আধিপত্য রক্ষা কিংবা হারানোর ভয়ে নব্য ক্ষমতাধর বিত্তবান নেতা-পাতিনেতারা ভীত হয়ে হাঙ্গামা বাধাবেন, ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট বা অন্যান্য অনিয়ম হবে। কিন্তু সর্বত্র হবে না, এবং ব্যবস্থা চালু থাকলে ধীরে ধীরে এসবই মূল ঘটনার বাইরে বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনার বেশি আর হবে না। ফলে সাহস করে শুরু করাই আসল কাজ।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একে একে তাঁর প্রতিপক্ষদের দমিয়ে এনেছেন। তাতে তিনি একভাবে জনসমর্থনও পেয়ে যাচ্ছেন। কারণ, প্রতিপক্ষ শক্তি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রাণভোমরা মুক্তিযুদ্ধ ও এর চেতনা সম্পর্কে সত্যের বিপরীতে রয়েছে। তদুপরি শাসক হিসেবে তাদের সম্পর্কে জনস্মৃতি এখনো অনুকূল নয়। কিন্তু যে প্রতিপক্ষ ঘরেই আছে, তাকে দমানোর চেষ্টা কেন জরুরি হয়ে পড়ল? এখানেও আমাদের মনে হয় তিনি বা তাঁরা যথেষ্ট নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না যে আরও বেশ কিছুকাল ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি নিরাপদ হয়েছে কি না। কারণ দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সরকার যদি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, তবে ক্ষমতার ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। বস্তুত তখন গণতন্ত্র যে অনিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করে সফলভাবে টিকে থাকে, সেই পরিবেশ তৈরি হবে। আওয়ামী লীগ নিজেদের ও বিপরীতে বিএনপির জনসমর্থন নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না বলে বর্তমান নিশ্চিত অবস্থান থেকে অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ গর্ভে বিপদের ভ্রূণ সঞ্চারের ঝুঁকি নিতে চায় না। কিন্তু তাতে খেসারত দিতে হচ্ছে গণতন্ত্র, জনগণ ও দেশকে।
গোড়ায় যে প্রবণতার কথা বলেছিলাম, সেই ধন ও ক্ষমতার বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকলে জনগণের গুরুত্ব ও শক্তির ওপর আস্থা আদতে ছুটে যায়। বর্তমানে আমাদের রাজনীতি জনগণের ওপর আস্থাহীনতার রোগে ভুগছে। সহজ পথটা নেতাদের মাথায় আসছে না, যদিও তাঁরা জনগণেরই নেতা-নেত্রী।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend