জান্নাতি, পুলিশপুত্র ও আইনের শাসন- এ কে এম জাকারিয়া

বনানীর এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন পথচারী মৃত্যুঞ্জয়
বনানীর এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন পথচারী মৃত্যুঞ্জয়

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় (৬ নভেম্বর ২০১৪) একটি লেখা লিখেছেন। ওই নিবন্ধের শুরুর লাইনটি হচ্ছে, ‘প্রশ্নটা হলো, আইন ও শাসন আলাদাভাবে থাকলেও আইনের শাসন আছে কি না। আইন আছে, শাসনও আছে, কিন্তু আইনের শাসন কি আছে?’ লেখাটির যে শিরোনাম তিনি দিয়েছেন, সেটাই অবশ্য বলে দিচ্ছে তিনি শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্তে এসেছেন; ‘আইন আছে, আইনের শাসন নেই’।
একই দিন প্রথম আলোর শেষের পাতার একটি খবর শাহদীন মালিকের শিরোনামের পক্ষে সাফাই হিসেবেই যেন হাজির হয়েছে। এ খবরটির শিরোনামে প্রশ্ন আছে, ‘দুর্ঘটনা না হত্যা?’ এই প্রশ্নের মীমাংসা করার দায়িত্ব আদালতের। তবে আইন নিজের মতো চলতে পারলে এবং সবার জন্য সমান হলেই এর সঠিক উত্তর মিলবে। মানে আইনের শাসন নিশ্চিত হতে হবে। প্রতিবেদনটি পড়লে যেকোনো পাঠকেরই এটা মনে হবে যে আইন হয়তো নিজের মতো চলছে না বা চলতে পারছে না।
অনেকেই হয়তো খবরটি পড়েছেন, যাঁরা পড়েননি তাঁদের জন্য ঘটনাটি সংক্ষেপে তুলে ধরছি। গত ১১ জুলাই রাতে মহাখালী ফ্লাইওভারের জাহাঙ্গীর গেটের কাছাকাছি এলাকায় এক গাড়ি দুর্ঘটনায় কে এম মোস্তামসির আশরাফ (২৭) নামের এক তরুণের মৃত্যু ঘটে। এ সময় গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁরই বন্ধু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জান্নাতি হোসেন। তাঁরা দুজন আবার ব্যবসায়িক অংশীদারও। ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় গাড়িটি একটি দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের পিকআপ ভ্যানকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে কয়েকজন পুলিশও আহত হয়। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে পুলিশের সামনেই। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে যে মামলা দায়ের করেছেন, তাতে তিনি লিখেছেন, ‘দুর্ঘটনার পর গাড়িটি দরজা ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। দেখতে পাওয়া যায়, গাড়ির চালকের আসনে একটি মেয়ে ও বাঁ পাশের আসনে একটি ছেলে আহত অবস্থায় পড়ে আছে। মেয়েটি তার পাশে থাকা ছেলেটিকে উদ্ধারের জন্য আমাদের সাহায্য কামনা করে চিৎকার করতে থাকে। আমি ফোর্সসহ ছেলেটিকে দরজা ভেঙে বের করে মেয়েটিসহ পাশের আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ছেলেটিকে মৃত ঘোষণা করে।’
একটি করুণ ও দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে এই কাহিনি এখানে শেষ হয়ে গেলে হয়তো পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হতো না। এ ঘটনার পর দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়ির চালক হিসেবে জান্নাতির বিরুদ্ধে বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তার ও নিয়ম অনুযায়ী কারাগারেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর নিহত মোস্তামসিরের চাচা বাদী হয়ে জান্নাতিসহ তাঁর পরিবারের আরও তিন সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। যে বাবা-মা ও পরিবার ২৭ বছরের তরুণ মোস্তামসিরকে হারিয়েছে, তাদের বেদনা বোঝা আমাদের জন্য কঠিন। পরিবার এ ধরনের সন্দেহ করতেই পারে, মামলাও করতে পারে। কিন্তু মামলার সাক্ষীর তালিকা ও এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আইন সম্ভবত নিজের মতো চলতে পারছে না।
দুর্ঘটনার পর থেকে (প্রায় চার মাস হতে চলেছে) জান্নাতি কারাগারে আটক রয়েছেন, কোনোভাবেই তাঁর জামিন মিলছে না। এ পর্যন্ত তাঁকে তিন দফা রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এ দেশে দুর্ঘটনা, চালকের অবহেলা ও এতে মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু কোনো চালককে সম্ভবত এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। মোস্তামসিরের পরিবারের পক্ষ থেকে অবশ্য জান্নাতির বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু এ প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে এমন নিখুঁতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে (তাও আবার পুলিশের গাড়িতে আঘাত করে) কি নিজে বেঁচে অন্যকে হত্যা করা সম্ভব?
জান্নাতির ক্ষেত্রে আইন কি নিজের মতো চলতে পারছে বা তাঁর প্রতি আচরণটি কি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? সব গাড়ি দুর্ঘটনা বা দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যুর পর কি চালকের এই দশা হয়? নিহত মোস্তামসিরের বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা (নিবন্ধন মহাপরিদর্শক)। তাঁর ভাই, যিনি মামলার বাদী, তিনি আওয়ামী লীগের নেতা। বাদীর পক্ষে সাক্ষীদের তালিকায় আছেন দুদকের মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক, আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা জজ ও দুদকের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিসহ ১৫ জন। মামলায় জান্নাতির বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, পুরো ব্যবসা বাগিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবসায়িক সহযোগী মোস্তামসিরকে হত্যা করা হয়েছে। এই মামলার সাক্ষীর তালিকায় এঁদের যুক্ত করার অর্থ কী? ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মামলার সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমি কেন হত্যা মামলার সাক্ষী, তা তো জানি না। তবে আইজিআরের (নিবন্ধন মহাপরিদর্শক) ছেলে মারা যাওয়ার কথা শুনে থানায় গিয়েছিলাম।’ দুদকের মহাপরিচালকও একই ধরনের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ঘটনা শুনে থানায় গিয়েছিলাম, সে কারণেই হয়তো সাক্ষী করা হয়েছে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ থানায় গেলেই তাঁকে মামলার সাক্ষী করা হবে? ঘটনার ব্যাপারে তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কী জানেন বা কতটুকু জানেন, সেটা কি কোনো বিবেচনার বিষয় নয়?
এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই সরকারি কর্মকর্তা বা প্রভাবশালীদের মামলার সাক্ষী করা হয়েছে। জান্নাতির পরিবার তাদের মেয়েকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়া ও জামিন না পাওয়ার ব্যাপারে যে অভিযোগ করেছে, তাকে তো উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সাক্ষী হওয়ায় পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করতে সাহস পাচ্ছে না। প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, সিআইডির কর্মকর্তারাও মনে করেন, ঘটনাটি দুর্ঘটনা। কিন্তু মামলায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাক্ষী হওয়ায় অভিযোগটি তাঁরা উড়িয়ে দিতে পারছেন না।
সংবিধান ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ বলে যে মৌলিক অধিকার নাগরিককে দিয়েছে এবং ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ বলে যে ঘোষণা দিয়েছে, তা দেখা যাচ্ছে জান্নাতির ক্ষেত্রে খাটছে না। কারণ, জান্নাতির মামলার সাক্ষীরা ‘প্রভাবশালী’ হওয়ায় বিষয়টিকে ভিন্নভাবে বিবেচনা করতে হচ্ছে। খবরটি পড়ে জান্নাতির মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। দুঃখ আর ক্ষোভ নিয়ে বললেন, ‘দুর্ঘটনায় আমার মেয়ে জান্নাতি বেঁচে যাওয়াতেই তাকে আজ এই নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে, যদি সে মারা যেত, তাহলে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠত না। যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁরা হয়তো আমার মেয়ে মারা গেলেই খুশি হতেন। কিন্তু এর ওপর তো আমাদের হাত নেই, এটা তো আল্লাহর হাতে।’ তিন দফায় ১২ দিন রিমান্ডে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে জান্নাতির মা বলেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা কোনো দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গেও করা হয় কি না, আমার সন্দেহ রয়েছে।’ নানা বাধা পার হয়ে জান্নাতির জামিন ও ন্যায়বিচারের আশায় তাঁর মা এখন উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আরেকটি দুর্ঘটনার ঘটনা বলি। গত ৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বনানীতে এক প্রাইভেট কারের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন পথচারী মৃত্যুঞ্জয় আচার্য (৪৮)। সেদিন জামায়াতের ডাকা হরতাল কর্মসূচি ছিল। বেপরোয়া গতির গাড়িটি মৃত্যুঞ্জয়কে চাপা দিয়ে ট্রাফিক সিগন্যাল পোস্ট ভেঙে ডিভাইডারের ওপর উঠে রাস্তার অন্য পাশে এসে থামে। গাড়ির সামনে কাচে ‘পুলিশ’ লেখা ছিল। এ ঘটনাটি হয়তো ধামাচাপা পড়ে যেত যদি ফেসবুকে ঘটনাটি ও গাড়িটির ছবি প্রকাশিত না হতো। হরতালের দিনের এই দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবরটি দিন তিনেক চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল। ৩০ অক্টোবর দুপুরের এই দুর্ঘটনার খবরটি গণমাধ্যমে প্রথম প্রকাশিত হয় ২ নভেম্বর (ডেইলি স্টার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর)।

যিনি এ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন, তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শকের ছেলে, জাফর সাদিক (২৩)।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গাড়ি চালালেও এই পুলিশপুত্র কোনো লাইসেন্স দেখাতে পারেননি।
দুটি দুর্ঘটনা, দুটি দুঃখজনক মৃত্যু। একটির শিকার একজন প্রভাবশালীর পুত্র, অন্যটি ঘটিয়েছেন এক প্রভাবশালীর পুত্র। প্রভাবশালীর পুত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় তিন দফা রিমান্ডে নেওয়া জান্নাতি এখনো জেলে। তাঁর মায়ের শেষ ভরসা এখন উচ্চ আদালত। মৃত্যুঞ্জয় মারা যাওয়ার ঘটনায় পুলিশপুত্র জাফর সাদিকের সে পথ মাড়াতে হয়নি। তাঁকে কে ধরবে আর তাঁর বিচারই বা করবে কে? শাহদীন মালিক তাঁর লেখায় লিখেছেন, আইনের শাসনের মূল কথা হলো ব্যক্তি গৌণ, নিয়মনীতি, আইন ইত্যাদিই প্রধান। ‘আইন’ ও ‘শাসন’—এই দুটি নিয়েই আমরা আইনের শাসনের উল্টো পথেই হাঁটছি। এখানে তো ব্যক্তিই সব।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend