শূন্য হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব-লুৎফর রহমান সোহাগ

Nettrittoশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও ছাত্র সংগঠনগুলোর নিয়মিত সম্মেলন না হওয়ায় জাতীয় রাজনীতি ক্রমশ নেতৃত্বশূন্য হচ্ছে। নেতৃত্বশূন্যতার সঙ্গে রয়েছে আরও কিছু কারণ। তাতে রাজনৈতিক সংগঠন ও সরকারের শীর্ষপর্যায়ে ব্যবসায়ী এবং আমলাদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনে সংসদ সদস্যদের প্রদত্ত হলফনামা অনুযায়ী, দশম সংসদে মোট ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে ১৭৭ জন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, যা মোট সংসদ সদস্যের ৫৯ ভাগ।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতাই দেশে নেতৃত্বশূন্যতা সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি এ সঙ্কট প্রকট হওয়ার আশঙ্কা তাদের।
জানা যায়, প্রায় দুই যুগ ধরে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে ডাকসু, ১৯৯২ সালে জাকসু, ১৯৮৬ সালে জকসু, ১৯৮৯ সালে রাকসু ও ১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র সংগঠনগুলোয় জবাবদিহিতা না থাকাও নেতৃত্ব বিকাশের অন্যতম অন্তরায় বলে মনে করেন বোদ্ধারা। ফলে মেধাবী ও যোগ্য নেতৃত্বের পরিবর্তে রাজনীতিতে জায়গা নিচ্ছে অপরাজনীতিকরা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ’৯০ পরবর্তী সময়ে আমাদের রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেনি। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। কাউন্সিলের মাধ্যমে ছাত্র সংগঠনগুলোতে নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হচ্ছে না। পাশাপাশি ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকায় বড় দুই দলের বাইরে থেকে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসছে না। আর এ কাজটি করা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে যারা থাকেন, তারাও রাজনৈতিকভাবে অবস্থান করেন।
তিনি বলেন, এখন রাজনীতি সংঘাত ও ক্ষমতানির্ভর হয়ে পড়ছে। দেশপ্রেমের রাজনীতি এখন আর নেই। ফলে রাজনৈতিক চর্চা যেমন হচ্ছে না তেমনি মেধাবীরা রাজনীতির প্রতি অনীহা হয়ে পড়ছেন। ভীত হয়ে পড়ছেন, যার ফলে নেতৃত্বের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। রাজনীতি হচ্ছে কেন্দ্রীভূত।
তিনি বলেন, এতে করে রাজনীতির মাঠ খালি থাকবে না। অগণতান্ত্রিক, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধীরা এ জায়গাগুলো দখল করবে। আমরা হয়তো চোখে দেখি না। কিন্তু এর সঙ্কেত বোঝা যাচ্ছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।
তিনি বলেন, রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিকাশ ফিরিয়ে আনতে দুই দলকে সাংগঠনিকভাবে গণতান্ত্রিক হতে হবে। পাশাপাশি তরুণদের সামনে আইডল তৈরি করতে হবে, যা দেখে তারা উদ্বুদ্ধ হবে।
এ বিষয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আব্দুর রব বলেন, অতীতে ছাত্র রাজনীতি সক্রিয় ছিল। কিন্তু এখন ভ্যানিটিব্যাগ থেকে বের করে কমিটি দেওয়া হচ্ছে। সে কমিটি আবার কেউ মানে না।
এ ব্যাপারে ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মুহাম্মদ মনসুর বলেন, স্বৈরাচার এরশাদ সরকারও দুইবার ডাকসু নির্বাচন দিয়েছিলে। কিন্তু গণতন্ত্রে উত্তরণের পর দীর্ঘদিনেও ডাকসু নির্বাচন হয়নি। ফলে আমরা অনেক নতুন নেতৃত্ব হারিয়েছি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী দ্য রিপোর্টকে বলেন, নেতৃত্ব বিকাশের যে প্ল্যাটফর্ম ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দরকার তা ৯০ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে ছিল। কিন্তু গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর আমরা নেতৃত্ব বিকাশে ব্যর্থ হয়েছি। ’৯০ পরবর্তী সময়ে এদেশে নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। সে সময় দূরে নয় যে, দেশে নেতৃত্বের হাহাকার আসবে। তৈরি হবে রাজনৈতিক শূন্যতা, বিপদে পড়বে গণতন্ত্র।
তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নির্বিচারে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের প্রভাব নেতৃত্ব বিকাশের প্রধান অন্তরায়। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচন করলেও তাদের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। বর্তমানে যা হচ্ছে তা হলো প্যাট্রোন-ক্লায়েন্টনির্ভর রাজনীতি। এতে মাঠের কর্মীরা ঝরে পড়ছে। পেশীশক্তি আর টাকার বিনিময়ে নেতা বানানো হচ্ছে। মোট কথা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার জন্য যা যা করা দরকার, তা হচ্ছে না। পাল্টা বাধা দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই- ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা।
তিনি বলেন, মাঠের লোককে মূল্যায়ন না করলে তারা সঙ্কটে সামনে আসবে না। ফলে যে কোনো আন্দোলনই ব্যর্থ হবে। বিএনপি যেমন এখন ব্যর্থ হচ্ছে তেমনি আওয়ামী লীগও ব্যর্থ হবে। কিন্তু ’৯০-এর পর অনেক বড় বড় ইস্যু তৈরি হয়েছে, যা দিয়ে অনেক বড় আন্দোলন গড়ে তোলা যেত।
অভিযোগ রয়েছে, অতীতে যেখানে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পরীক্ষা দিয়ে ছাত্রনেতারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হতেন সেখানে বর্তমানে পকেট কমিটি তৈরি করে, বিভক্তি তৈরি করে মেরুদণ্ডহীন ছাত্রনেতা তৈরি করা হচ্ছে। একই কমিটি দীর্ঘদিন বহাল রেখে নতুন নেতৃত্ব বিকাশের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোতে চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কেবল দখলদারিত্ব, পদ-পদবী, অর্থবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। পেশীশক্তিনির্ভর রাজনীতিতে মেধাবীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় রাজনীতি এখন বখাটেদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।
এ ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মানবেন্দ্র দেব দ্য রিপোর্টকে বলেন, রাষ্ট্র প্রগতিকে আটকে দিতে চায়। তাই যে সব জায়গা থেকে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটার কথা, তা আটকে দেয় নিজের নেতৃত্ব ও ক্ষমতাকে সংহত করতে।
তিনি বলেন, দেশে নেতৃত্বের বিকাশের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলো কুক্ষিগত করে রাখা ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রাখা। পরিকল্পিতভাবে ২৪-২৫ বছর ধরে তা করা হচ্ছে। ফলে জবাবদিহিতা ও নেতৃত্ব বিকাশ হারিয়ে যাচ্ছে, যার প্রতিফলন বর্তমান রাষ্ট্রের মধ্যেই আছে। আসলে তারুণ্যের প্রতি ভয় ও অনীহা থেকেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। পরিচ্ছন্ন ও স্বাভাবিক রাজনীতির গতিরোধ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র একটি শব্দ বা নির্বাচন নয়, এটি চর্চার বিষয়। এ চর্চা থেকেই যুবক, ছাত্র ও শ্রমিকদের থেকে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু এ চর্চা থেকে সবাইকে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বিরাজনীতিকরণ চলছে। সুশীল সমাজ ও কতিপয় রাজনীতিক মিলে ক্ষমতা ধরে রেখে শোষণ পরিচালনা করতে এ ষড়যন্ত্র করছে।
এদিকে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও পোস্টার, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ফটোসেশন করে জনবিচ্ছিন্ন অনেকেই নেতার তকমা গায়ে লাগাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসিম আখতার হোসাইন দ্য রিপোর্টকে বলেন, এ সব বাজারি রাজনীতি। এভাবে রাজনীতিকে পণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু বাজার বড় নিষ্ঠুর। এরা টিকবে না।
তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ হয়নি। এ ধরনের দেশে শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন যেখানে সক্রিয় থাকার কথা ছিল, তা নেই। শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে আমরা ছাত্র রাজনীতির দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু এখন সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই। সব স্থবির হয়ে পড়েছে। একটা বন্ধ্যাত্ব চলছে, যা আগে দেখিনি।
তিনি বলেন, যেটাকে এখন রাজনীতি বলা হচ্ছে তা ভয়ঙ্কভাবে কলুষিত। এটাকে রাজনীতি বললে ভুল হবে। কিন্তু এ অবস্থা চললে বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, যার ফলে নতুন নেতৃত্বের দেখা মেলে। শাহবাগ ছাড়াও আরও ছোট-ছোট, খণ্ড-খণ্ড বিকাশ আমরা দেখেছি। এ সব যোগ করে বড় করা যায়। কিন্তু তাও বাধা পাচ্ছে। ফলে তা দীর্ঘ পরিবর্তন আনতে পারছে না। আবার এটা রাজনীতিও না। রাজনীতি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর বাইরে সংগঠিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু ভালো নেতা সংগঠন থেকেই আসবে। বাইরে থেকেও আসবে। কিন্তু তা সাংগঠনিক না।
গণতন্ত্রের নামে পরিবারতন্ত্র, লেজুড়বৃত্তি ও ছাত্র রাজনীতিতে শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপের কারণেও নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না বলে মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে সঙ্কটের বিষয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না দ্য রিপোর্টকে বলেন, দেশে নেতৃত্ব বিকাশের সঙ্কট চলছে। অনেকেই নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন। কিন্তু তাদের বড় ধরনের চাপে রাখা হচ্ছে। তাদের নেতৃত্ব বিকাশ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া এক। কারণ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটলে তাদের সন্তানদের ভয় আছে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend