জেলহত্যা দিবস ; তাজউদ্দীন আহমদ ও ফজলুল হক হলের স্মৃতি – সিমিন হোসেন রিমি

14cb9409a859b2c15bf7c44574d21558-1তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে জানা যায়, তিনি ফজলুল হক মুসলিম হলে থাকতেন। সম্প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের চিঠি বইটি প্রকাশিত হলে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি এই হলের নর্থ ১২ নম্বর কক্ষে থাকতেন। স্নেহাস্পদ জহির এই হলের আবাসিক ছাত্র। ওর প্রবল আগ্রহ সঠিক কক্ষটি চিহ্নিত করা। বর্তমানে কক্ষ নম্বর শ দিয়ে শুরু। ডান পাশের সিঁড়ির দিক দিয়ে গুনলে সঠিক হবে, না বাঁ দিকের টয়লেটের দিক দিয়ে—এমন নানা প্রশ্ন জহিরের মনে। নিচতলার একপাশের সংস্কার হয়েছে। চারজনের থাকার ব্যবস্থা ছিল এমন কক্ষের মাঝে দেয়াল তুলে এখন দুজনের থাকার ব্যবস্থা।
জহির আমাকে ফোন করে। অনেকের নাম মনে পড়ে। একই সঙ্গে বেদনা অনুভব করি—অনেকেই বেঁচে নেই আজ। আমার জানা দু-তিনটি ফোনে যোগাযোগ করে শেষে পেয়ে যাই প্রকৌশল বিজ্ঞানি জনাব আব্দুল মতিনকে। মতিন চাচা তাঁর বড় ভাইয়ের সঙ্গে (বড় ভাই আব্দুল মোমেন ছিলেন রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী) মাস তিনেক ছিলেন সেই একই রুমে।
আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে দুটি দিন পার করে গত ১৬ অক্টোবর সকালে ফজলুল হক মুসলিম হলে যাই।
মতিন চাচা পুলকিত। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে থাকেন—এই যে ডান পাশটায় শবরাতী দাড়োয়ান বসে থাকত। এই পাশটাতেই কাপাসিয়ার নানা ধরনের মানুষ এসে দাঁড়িয়ে অথবা বসে থাকত। তাজউদ্দীন ভাই তো খুব ডিসিপ্লিন মানুষ ছিলেন, হলে বাইরের মানুষ ঢুকতে দিতেন না। নিজে বাইরে এসে কথা বলতেন। ওই সমস্ত লোকের কেউ আসত চিকিৎসার জন্য, কেউ মামলা, কেউ দরখাস্ত লেখিয়ে নেওয়াসহ নিজস্ব নানা কাজে। তাদের কারও কারও হাতে থাকত গ্রাম থেকে আনা মুড়ি অথবা ফল। কক্ষের সামনের টানা বারান্দায় উঠে দুই দিক থেকে কক্ষগুলোর অবস্থান দেখে তিনি যে কক্ষটি দেখালেন, তার বর্তমান নম্বর ১২২।
চারজনের কক্ষকে দেয়াল তুলে দুজনের কক্ষ করা হয়েছে। তাজউদ্দীনের পড়ার টেবিল সে সময় যেমন রাখা ছিল, এখনো তেমনি। বই রাখার জন্য দেয়ালে তাক ছিল, তা-ও আছে।
মতিন চাচা বললেন, তাজউদ্দীন ভাই ভীষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ ছিলেন। এই কক্ষে থাকতেন আব্দুল মোমেন, সফর আলী আকন্দ (ইতিহাসের শিক্ষক, লেখক), বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী ও তাজউদ্দীন। তাজউদ্দীন আহমদ বেশ সকালে উঠতেন, হয়তো লেখালেখি করতেন অথবা বই পড়তেন। কক্ষের দরজা দিয়ে বের হলেই বারান্দা থেকে মেইন গেট দেখা যেত। মোমিন সাহেব প্রায় দিনই তাজউদ্দীনকে লক্ষ্য করে বলতেন, ‘তাজউদ্দীন সাহেব, ওই যে আপনার মক্কেলরা চলে এসেছে।’ তাজউদ্দীন বের হয়ে দেখে নিতেন কে, তারপর নিজের কাজ শেষ করে দেখা করতেন বা কখনো সঙ্গে সঙ্গেই দেখা করতেন।
শবরাতী দাড়োয়ানও কেউ এলে খবর দিত। এর পাশের কক্ষে থাকতেন জিল্লুর রহমান (সাবেক রাষ্ট্রপতি) ও বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ। তার পরেই ছিল টয়লেট। তাজউদ্দীন সাহেব কাপড় ধুয়ে সামনের মাঠের ঘাসে এমন সুন্দর করে মেলতেন যে পরে ভাঁজ করে বিছানার তোশকের নিচে রেখে দিলে ইস্ত্রি করতে হতো না। প্রায় প্রতিদিনই তাজউদ্দীনের নাশতা ছিল নিজ হাতে ধোয়া চিড়া, গুড় ও কলা। তিনি বলতেন, সারা দিন কখন কোথায় যাই—আমার জন্য এ খাওয়াই ভালো। তাজউদ্দীন ছিলেন ভীষণ সহজ-সরল, বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানী মানুষ। আড়ম্বর একেবারেই পছন্দ করতেন না। আমাদের কথার ফাঁকে বেশ অনেক ছাত্র জড়ো হয়। যে ছেলেটি এই কক্ষের তাজউদ্দীনের অংশের বাসিন্দা, মুঠোফোন পেয়ে সে-ও এসে হাজির হয়। পরিসংখ্যানের ছাত্র সে। আমরা সবাই একসঙ্গে ঘাটলা বাঁধানো পুকুরপাড়ে যাই। মতিন চাচার কথায় দেখতে পাই, এই তো এই কোণে অথবা ওই কোণে বসে রাষ্ট্রভাষা অথবা রাজনীতির নানা বিষয়ে আলাপ করে চলেছেন সেদিনের ছাত্র একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সফল কান্ডারি এবং আরও অনেক সহযোদ্ধা!
শান্ত পুকুরের টলটলে পানিতে আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয় হঠাৎ দ্রুত গতিতে সাঁতরে চলা পাঁচ-ছয়টি হাঁস। বীরদর্পে এগিয়ে চলে হাঁস, পানিতে সৃষ্টি হয় স্রোতোধারা। যে স্রোতোধারায় আমরা খুঁজে পাই ইতিহাসের উপকরণ।
রাতে মতিন চাচা আবার ফোন করেন। আমি ভাবি, হয়তো মনে হয়েছে আরও কোনো কথা। মতিন চাচা অত্যন্ত উৎফুল্ল কণ্ঠে জানান, সফর আলী আকন্দকে ফোনে পাওয়া গিয়েছে, তিনি এখন ঢাকায় আছেন। সফর আলী আকন্দ চাচার সঙ্গে দেখা করে ফিরে যাই সেই দিনে। তিনি বলেন, তাজউদ্দীন ছিলেন বিরল চরিত্রের মানুষ। তাঁর ছিল সবার জন্য উৎসর্গীকৃত একটি মন। যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করার মতো মনোবল। ন্যায়পরায়ণতা, সততা ছিল তার সহজাত। তাজউদ্দীনের মতো মানুষ সেকালে যেমন বিরল ছিল, একালে আরও বিরল।
তিনি আরও যোগ করলেন, আমার একবার অর্থসংকট দেখা দেয়। তাজউদ্দীন বুঝতে পারেন। তিনি একদিন তাঁর সাইকেলে আমাকে বসিয়ে পাটুয়াটুলিতে বেগম পত্রিকা অফিসে নিয়ে যান। তিনি চেয়েছেন আমার অসুবিধা দূর হোক। মিটিংয়ে-মিছিলে যেতে তিনি উদ্বুদ্ধ করতেন। অনেক দিন তিনি আমাকে সাইকেলে বসিয়ে সভা-জনসভায় নিয়ে গিয়েছেন।
তাজউদ্দীন নিবেদিত ছিলেন সকল মানুষের জন্য, বিশেষ করে কাপাসিয়ার মানুষ ছিল তাঁর অন্তঃপ্রাণ। ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে কাপাসিয়ার মানুষ আসত তাঁর কাছে সুপরামর্শের জন্য, তাদের বিভিন্ন কাজের জন্য। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা ছিল মানুষের জন্য কিছু করা। অত্যন্ত ভদ্র আচরণ ছিল তাজউদ্দীনের। তাঁর খুব অদ্ভুত বিষয় ছিল, যেকোনো বিষয় খুব দ্রুত তিনি বুঝে ফেলতেন। একই সঙ্গে প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন তিনি। যেমন জিন্নাহ সাহেব মারা যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন প্রদেশের প্রধান ব্যক্তিরা দলীয় প্রধান হতে থাকলেন। সরকারপ্রধান ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি তখন। সরকারের কাজ এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য আর থাকল না। সেই ১৯৪৮ সালে তাজউদ্দীন আহমদ বুঝেছিলেন, পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বিলীন হতে চলেছে। এখানে গণতন্ত্র আর থাকবে না।


১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে তাজউদ্দীন আহমদ যে ভাষণ দেন, তার একটি অংশে তিনি যুবকদের প্রসঙ্গে কথা বলেন।
তাজউদ্দীন বলেন, ‘যুবকদের সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলে যাই। কলেজে যারা প্রবেশ করে, তারাই তো যুবক হয়ে যায়। কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দেয়, তার জন্য কী ব্যবস্থা? …আগের লোকসংখ্যার জন্য ঢাকায় যে স্কুল-কলেজ ছিল, যে ব্যায়ামাগার ছিল, বর্তমানে তা কি বাড়ছে, না কমছে? মতিঝিল, দিলকুশা এলাকায় জিপিও হয়েছে। ওই পুরো এলাকাটা খালি ছিল। ছোটবেলায় আমরা ওখানে খেলাধুলা করেছি। এক একটা স্কুলের জন্য এক একটা খেলার মাঠ ছিল। কলেজগুলোরও নিজস্ব মাঠ ছিল। আর বর্তমানে লোক বেড়েছে, সন্তান-সন্ততি বেড়েছে। খালি জায়গায় ইমারত হয়েছে, বাড়িঘর হয়েছে। মানুষের তুলনায় যেখানে মাঠঘাট বাড়ার কথা, সেখানে কমে গেছে। …যুবকদের পড়াশোনার সাথে সাথে মন ও মননশীলতা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। পাঠাগারের সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে। খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে।
‘আমি ঢাকা শহরের কথা বলছি, সাথে সাথে সমস্ত জেলা ও মহকুমা সদর দপ্তর এবং অন্যান্য ঘনবসতি এলাকায় পাঠাগার ও খেলার মাঠ গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধু, আপনি হুকুম দিয়ে দিন, ঢাকায় এক মাইল লম্বা আর আধা মাইল প্রশস্ত একটা জায়গা নিয়ে ছেলেদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দিন। নিষ্কলুষ আনন্দ লাভের সুযোগ করে দিন। তা না হলে এরা ফুটপাতে ঘুরে বেড়াবে। ঘুরে বেড়ালে সাধারণত কী হতে পারে, চিন্তা করে দেখুন। হাত শুধু পকেটেই যাবে না; নানান দিকে যাবে।
‘কাজেই যুবকদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ সোনার বাংলার যুবক হিসেবে তারা গড়ে ওঠে।’
(সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃষ্ঠা ৪১০-১১)


আজ জেলাহত্যা দিবস। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যে স্থানে এই চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, সেই স্মৃতির স্মরণে একটি জাদুঘর ও ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু যে স্থানে বন্দী থেকেছেন তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময়, সেখানেও স্মৃতি স্থাপনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় তৈরি হয়েছে এই কারা জাদুঘর। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের সকলের চাওয়া, আমরা জানি কারাগার এখান থেকে স্থানান্তরিত হচ্ছে। সেই সময় যেন পুরো এলাকাটিকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় জনসাধারণের জন্য। যেটুকু জাদুঘর, তা সেভাবেই থাকবে। এমনকি জেলখানার ভেতরের আরও কিছু স্থাপনা একই রকম থাকল দর্শনার্থীদের জন্য। বাকি অংশে খেলার ব্যবস্থা, পাঠাগার, সবুজ খোলা চত্বর, ফুলের বাগান। এক টুকরো সবুজ বদলে দেবে অনেক কিছু।
সিমিন হোসেন রিমি: সংসদ সদস্য, সমাজকর্মী।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend