ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র: যত প্রচার তত উপকার পাচ্ছে না গ্রামের মানুষ – মিজানুর রহমান সোহেল

UISC-640অনেক ঢাক-ঢোল পেটানো হলেও প্রকৃতপক্ষে দেশের ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রগুলো গ্রামের মানুষের খুব একটা উপকারে আসছে না। সর্বস্তরে ডিজিটাল তথ্যসেবা সম্প্রসারণের এ উদ্যোগ থেকে বাস্তবে মিলছে না কাক্সিক্ষত মানের সেবা। চড়া মূল্য, ইন্টারনেটের শ্লথগতিসহ বিভিন্ন কারণে অনেক তথ্যসেবা কেন্দ্রের অবস্থাই নাজুক। সরেজমিনে সিলেটের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের তথ্যসেবা কেন্দ্র ঘুরে পাওয়া গেছে এসব চিত্র। দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে।

পত্রিকাটি বলছে, জনগণের দোরগোড়ায় ডিজিটাল তথ্যসেবা পৌঁছে দিতে সরকার ২০১০ সালে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু তথ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা। যেরকম প্রচার চালানো হয়েছিল সেরকম উপকার পাচ্ছেন না গ্রামের মানুষ। ইউনিয়নগুলো নিজস্ব তহবিল থেকে দু-একটি কম্পিউটার কিনে এসব সেবা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দেয়া হয়েছে পরিচালনার দায়িত্ব। ফলে উদ্যোক্তার মর্জিমাফিক চলছে এসব কেন্দ্র।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে সিলেটের তেতলি ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, এ কেন্দ্রের প্রতিটি সেবার মূল্য বাবদ চড়া দাম নেয়া হচ্ছে। বাজারে যে দামে এসব সেবা পাওয়া সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা নেয়া হচ্ছে। এই সেবা কেন্দ্রে এক ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করলে নেয়া হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। একটি ই-মেইল পাঠাতে নেয়া হয় ২০ থেকে ৩০ টাকা। অথচ বাইরের বিভিন্ন দোকানেও প্রতি ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য নেয়া হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এ ছাড়া সেবা কেন্দ্রটির কোথাও সেবামূল্যের তালিকা টাঙানো নেই। এর ফলে সাধারণ মানুষ তথ্যসেবা নিতে এই কেন্দ্রে তেমন একটা যান না। প্রায় ৩৬ হাজার অধিবাসীর এ ইউনিয়নের তথ্যসেবা কেন্দ্রে দিনে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৬ জন তথ্যসেবা নিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে।

জানতে চাওয়া হলে তথ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো. ইমরান বলেন, এখানে পাবলিক পরীক্ষার ফল, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম পূরণসহ বিভিন্ন সেবার জন্য শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা খুব কমই আসেন। বিশেষ করে কিছু এনজিও থেকে ই-মেইল পাঠাতে আসে। সেবা কেন্দ্রটিতে এই প্রতিবেদকের অবস্থানকালেই তেতলির মাস্টারবাড়ির আনোয়ার আলী একটি উত্তরাধিকার সার্টিফিকেট নেন। এই সেবা বাবদ তার কাছ থেকে নেয়া হয় দেড়শ টাকা। এক পৃষ্ঠা প্রিন্ট বাবদ ৫০ টাকা আর ইউনিয়ন পরিষদের ফি বাবদ ১০০ টাকা।

একটি প্রিন্টের জন্য এত চড়া দাম কেন জানতে চাইলে ইমরান বলেন, এখানে সেবার মূল্য সুনির্দিষ্ট করা নেই। অনেকে কমও দেন। এই সেবা কেন্দ্র থেকে গত জুলাই মাসে সেবা গ্রহণকারীর তালিকা থেকে দেখা গেছে, কোনো দিন একজন, কোনো দিন দুজন করে তথ্যসেবা নিয়েছেন। ওই মাসে এক দিনে সর্বোচ্চ তথ্যসেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ছয়। এসব ব্যক্তি যেসব সেবা গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে- ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ই-মেইল পাঠানো, ফটোকপি ও ছবি উঠানো। কিন্তু কেউ পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম পূরণ, অনলাইনে জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন, ভিজিএফ-ভিজিডি মোবাইল ব্যাংকিং, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, চাকরির তথ্য জানা, ভিসা আবেদন ও ট্র্যাকিং করতে বা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মতো কোনো সেবা গ্রহণ করেননি।

জানতে চাইলে তেতলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উছমান আলী বলেন, উদ্যোক্তাদের আয় অনেক। কিন্তু প্রকৃত আয় তারা দেখায় না। তারা ভাবে প্রকৃত আয় দেখালে সরকার তাদের সরকারিকরণ করবে না। তবে সেবার চড়া মূল্য নেয়ার বিষয়টি তিনি অবগত নন বলে জানান। তিনি বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ঘণ্টাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা নেয়ার কথা। কেন বেশি নেয়া হচ্ছে তা আমি জানি না। কেউ আমার কাছে অভিযোগও করেনি। এই কেন্দ্রের সমস্যা সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে ইন্টারনেটের গতি কিছুটা কম। গতি বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

সরেজমিনে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যসেবা কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ই-মেইল পাঠাতে ২০ টাকা লাগে। আর এক ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারে লাগে ১০ টাকা। এই সেবা কেন্দ্রে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বেশি। জানতে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদ আহমদ বলেন, এখানে ইন্টারনেটের গতি কিছুটা কম থাকায় সেবা দিতে সমস্যা হয়। সরকার সেবা কেন্দ্র ঘোষণার পর তেমন কিছুই দেয়নি। ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব টাকা দিয়ে কম্পিউটারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ কিনেছি। তবে ইন্টারনেটের লাইনটা সরকার দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই জনগণ তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে উপকৃত হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইউনিয়নগুলোতে ইন্টারনেটের গতি একটি বড় সমস্যা। নেটওয়ার্কের সমস্যা লেগেই থাকে। ফলে ঠিকমতো সেবা মেলে না। এ ছাড়া সেবা কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে থাকায় তারা তাদের খেয়াল-খুশি মতো তা পরিচালনা করেন। সাধারণ মানুষ এর ফলে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, তথ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ আসলে ভাঁওতাবাজি। এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। গ্রাম এলাকায় এখন অনেক কম্পিউটারের দোকানেই এসব সেবা পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও থানা নির্বাহী কর্মকর্তারা (টিএনও) তথ্যসেবা কেন্দ্রকে যেভাবে তুলে ধরেন তাতে মনে হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নেই। তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে সব সেবা তারাই দিচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদ কোনো জায়গা পাচ্ছে না। আমরা বুঝে না বুঝে লাফাচ্ছি। এভাবে ইউনিয়ন পরিষদকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

তবে তথ্যসেবা কেন্দ্র নিয়ে আশাবাদী সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এসব কেন্দ্র থেকে কিছু কিছু সেবা পাওয়া যাচ্ছে। কাস্টমার কম হওয়ায় হয়তো চার্জ বেশি। কিন্তু তথ্যসেবা গ্রামে পৌঁছাতে হবে। নইলে দেশ উন্নত হবে না। তবে এ ব্যাপারে সরকারি সহযোগিতা বাড়াতে হবে। ইন্টারনেট চার্জ কমাতে হবে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend