একটি মালালার গল্প -খোন্দকার মেহেদী আকরাম

malala_yousafzai_courage১৯৯৭ সনটি ছিল আমার জীবনের একটা স্বরণীয় বছর- এ বছরই আমি ভর্তি হই শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে। বছরটিতে আমার বাবা-মা’র আনন্দের সীমা ছিল না। তাঁদের ছেলে ডাক্তার হবে,- এ যে তাদের দীর্ঘ দিনের এক লালিত স্বপ্ন! ওই বছররেরই জুলাই মাসে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে, পাহাড়ে ঘেরা সোয়াত উপতক্যায় জন্ম নেয় ফুটফুটে এক কন্যা শিশু। আনন্দে দিশেহারা মা-বাবা মেয়টির নাম রাখে ‘মালালা’। মালালা নামটি ওর বাবা-মা রেখেছিল আফগানিস্থানের এক বিশিষ্ট কবি এবং যোধ্যা ‘মালালি’ র নামনুসারে। মালালার বাবা কি ভেবেছিল যে মেয়েটি তার বড় হয়ে সত্যি সত্যি হবে এক নির্ভিক বিখ্যাত কোনো কেও? মালালার বাবা কি ভেবেছিল ১৭ বছর পরে কি ঘটতে যাচ্ছে তার আদরের কন্যাটির জীবনে?

শিশু মালালা বেড়ে উঠে অপুরূপ সোয়াত উপতক্যার কোলে। একবার রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সোয়াত শহর ভ্রমন করে বলেছিলেন ‘এ যেন সুইজারল্যান্ড এরই এক প্রতিরূপ’! সময় যায়। ফুল পাখি আর ঝর্ণা জলে প্রস্ফুটিত হয় এক চঞ্চল নির্ভিক হৃদয়ের। আর দশটা সাধারণ শিশুর মত এক বুক আশা নিয়ে মালালা শুরু করে ইস্কুল জীবন। মনে মনে লালন করে এক অতি সাধারণ স্বপ্ন: বড় হয়ে সে হবে একজন ডাক্তার! সেবা করবে মানুষের।

কিন্তু হায়! ১০ বছরেই মালালার স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান। তালেবান হায়নার দল ভেঙ্গে দিল সব ইস্কুল। নোংরা হায়নার দল ফতওয়া জারি করলো: “নারী শিক্ষা বন্ধ। মেয়েরা সব ঘরে থাকবে।“ দশ বছরেই মালালার স্বপ্ন ভেঙ্গে হয় দশ টুকরো! টু শব্দটি নেই চার পাশে। মালালা দেখে সে একা নয়, তার সহপাঠীদের স্বপ্ন ভেঙ্গেও খান খান। সবাই গুন গুন করে কাঁদে। ছিন্ন ভিন্ন স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে ভেসে যায় উপতক্যার ঝর্ণা জলে। মালালা চিত্কার করে কাঁদে। হায়নারা গলা টিপে ধরে। মালালার দম বন্ধ হয়ে আসে।

পড়ন্ত ২০০৮ এ এগারোতে পরে মালালা। চারদিকে তালেবানের হুঙ্কার আর বোমার শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। আজ মালালা আর স্বপ্ন দেখেনা যে সে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। তালেবানের নোংরা বুটে নিষ্পেষিত মালালা স্বপ্ন দেখে সে রাজনীতিবিদ হবে। সে বড় হয়ে সব ইস্কুল খুলে দিবে। সে পাল্টা ফতওয়া দিবে, “নারী শিক্ষা বন্ধ নয়। মেয়েরা সব ইস্কুলে যাবে।” সহ পাঠিদের মরে যাওয়া স্বপ্ন গুলো দেখে মালালা চিত্কার করে কাঁদে। মালালার দীর্ঘশ্বাস গুলো উপতক্যার পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। হায়নার দল শুঁকে শুঁকে খুঁজে মালালার রক্ত!

জানুয়ারী ২০০৯।

আজ দম নেয়ার একটু ফুরসত পায় মালালা। তিল তিল করে জমে থাকা কথাগুলো উর্দুতে সে লিখে চলে ডায়রির মত করে ব্লগের পাতা ভরে বিবিসি’র ওয়েব সাইটএ। জনৈক ‘আমের আহমেদ খান’ ই সুযোগ করে দেয় তাকে। আজ থেকে মালালা ‘গুল মাকাই’! তালেবানের ভয়ে ‘যোধ্যা কবি’ আজ ‘ভুট্টা ফুল’! গুল মকাই হয়ে অকুতোভয় মেয়েটি জীবন বাজি রেখে লিখে চলে মালালা নামের মেয়েটির প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদের সুর হার মানায় অ্যান ফ্রাঙ্ক এর ডায়রিকেও! তালেবানি পশু গুলো ফোঁশ ফোঁশ করে। হায়নাগুলো মাটি শুঁকে শুঁকে খুঁজে বেড়ায় ‘গুল মাকাই’ কে! আর গুল মাকাই বেঁচে থাকে মালালার মাঝে অতি সঙ্গোপনে! দিন যায়, ডায়রির পাতা ভরে উঠে প্রতিবাদে। একটি মামলার ভয়, একটি প্রতিবাদ। একটি মালালার স্বপ্নভঙ্গ, একটি প্রতিবাদ।

ডিসেম্বর ২০০৯।

গুল মকাই এর খোলস ছেড়ে দিবালোকে বেড়িয়ে আসে নির্ভিক মালালা। আর নয় ছদ্দবেশ। তালেবানের বিরুদ্ধে রেডিও-টিভিতে আজ মালালার সরব উপস্থিতি। উচ্চস্বরে মালালা আজ বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানায় “If you can help us in our education, so please help us.” তালেবানি হায়ানাগুলো- মোল্লাগুলো ভিত হওয়া পড়ে। মালালাকে কেন তারা ছিড়েকুঁড়ে খায়নি আগে? মেয়েটি যে ছিল ওদের নখদর্পনেই! মোল্লাগুলো হাহাকার করে। সোয়াত উপতক্যার ঝর্ণা-জলে জন্ম নেয় নারীশিক্ষা অধিকার আদায়ের এক কিশোরী পথিকৃত! ইতিহাস সাক্ষী হয়ে থাকে।

গোটা পৃথিবী ঘুরে তাকায় সোয়াত উপতক্যায়। মানবাধিকারের বিবেকগুলো লজ্জিত হয়! ১২ বছরের লাজুক এক কিশোরী মালালা যা পেরেছে ওরা তা পারেনি কেন আগে? মেকি সব নোমিনেশন আর চকচকে অ্যাওয়ার্ড নিয়ে এগিয়ে আসে লজ্জিত বিশ্ববিবেক! মালালা তো এগুলো চায়নি! মালালার স্বপ্নে তো এগুলো ছিল না! মালালা তো শুধু চেয়েছিল ইস্কুলে যেতে। মালালা চেয়েছিল বড় হয়ে একজন ডাক্তার হতে। মালালা কি জানে নোমিনেশন কি? মালালা কি জানে International Children’s Peace Prize কি? মালালা তো শুধু জানে সামনে তার পরীক্ষা। তার ইস্কুল খোলা চাই-ই-চাই। তাহলে কেন ওরা এমন করছে? কেন ওরা ডাকছে অ্যাওয়ার্ড নিতে? নোমিনেশন কি? অ্যাওয়ার্ড কি? কিশোরী মালালা তা জানে না। শিশু মালালা শুধু চেনে ফুল পাখী ঝর্ণা, আর আকা বাকা পথ যা তাকে নিয়ে যায় তার প্রিয় ইস্কুলে। তালেবানি কষাই গুলো অস্ত্র শানে। ঝোপের পাশে ওঁত পেতে থাকে!

ডিসেম্বর ২০১১।

ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে পাকিস্তান দেশের প্রধান ইউসুফ রাজা গিলানি। বলে মালালা তুমি মহান, এই নাও অ্যাওয়ার্ড ‘পাকিস্তান জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কার’! তালেবানি পশু গুলো ফোঁশ ফোঁশ করে। মালালা এগিয়ে চলে, নারী শিক্ষা অধিকার আদায়ে স্থাপন করে ‘মালালা এডুকেশন ফাউন্ডেশন’ নামের এক সংস্থা। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় নপুংশক তালেবান মোল্লাদের। ২০১২ গ্রীষ্মের কোনো এক দুপুরে কোনো এক নপুংশক তালেবান জানোয়ার শপথ নেয় মালালাকে হত্যার!
৯ অক্টোবর ২০১২।

পরীক্ষা শেষে বাসে করে মালালা বাড়ি ফিরছে। মুখোশধারী নপুংশক তালেনাটি গুলি করে মালালার কপালে। ভিরু নপুংশক এর নিশানা বলে কথা। গুলিটি মস্তিস্কে না ঢুকে খুলির গা’ ঘেঁষে চামড়ার নিচ দিয়ে গলা বেয়ে কাঁধে গিয়ে গেঁথে পড়ে। মালালা বেঁচে যায় একটুর জন্য। সাহসী সুন্দর আত্মা গুলো এভাবেই বেঁচে যায় কালে কালে। ইতিহাস স্বাক্ষী হয়ে থাকে।

বেঁচে গিয়ে মালালা প্রমান করে শুদ্ধ আত্মা কতটা শক্তিশালী হতে পারে। ১৫ বছর আগে এক সাহসী পশতু যোদ্ধা এবং কবির নামে যে মালালার নাম রাখা হয়েছিল তা যথার্থই ছিল। কিশোরী মালালাতো একজন যোদ্ধাই। বিশ্ববিবেক সর্বদাই বিজিতের বন্দনা করে। আর তাইতো বিখ্যাত সংগীত শিল্পী মেডোনা তার গান উত্সর্গ করে মালালাকে। জাস্টিন বিবার উদগ্রীব হয়ে থাকে মালালার সাথে নারীশিক্ষা অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য। বিখ্যাত অভিনেত্রী এঞ্জেলিনা জলি ২ লক্ষ ডলার দান করে মালালা ফান্ডে। টাইম ম্যাগাজিন এ সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হয় মালালা। ইউনিভার্সিটি অফ কিংস কলেজ তাকে সন্মানিত করে ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়ে । ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবরা তাকে সন্মানিত করে মাস্টার্স ডিগ্রী দিয়ে। এছাড়াও মালালাকে সন্মানিত করা হয়েছে ডর্জন খানেক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরুস্কার দিয়ে।

আর এ বছর মালালাকে দেয়া হলো শান্তিতে নোবেল পুরুস্কার। এত কিছুর পরও কি মালালা শান্তিতে নোবেল পুরুস্কার পাওয়ার উপযুক্ত নয়? এটা সত্য যে শান্তিতে নোবেল সব সময়ই কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি করে । হেনরি কিসিঞ্জার, জিমি কার্টার, শিমন পেরেস এবং বারাক ওবামাকে যদি শান্তিতে নোবেল পুরুস্কার দেয়া হয় তাহলে মালালকে দিলে দোষ কোথায়? দিনের পর দিন বিতর্কিত ব্যক্তিদের শান্তিতে নোবেল পুরুস্কার দিয়ে নোবেল পুরুস্কারটি কলুষিত হয়েছে। আমি মনে করি, শান্তিতে নোবেল পুরুস্কারটি মালালাকে দেয়াতে বরং শান্তি-নোবেল পুরুস্কারটিই কলঙ্ক মুক্ত হয়েছে। অভিন্দন জানাই মালালাকে।

খোন্দকার মেহেদী আকরাম
(চিকিৎসক এবং বিজ্ঞান গবেষক)
শেফিল্ড
১৩ অক্টোবর ২০১৪

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend