[ ই তি হা স ] কে ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি?

[ ই তি হা স ]  কে ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

কেনা জানে যে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে অসমর্থ ছিলেন। সে অবস্থায় রাষ্ট্রপতির কার্যভার চালিয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়সহ বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত, তাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালের যুগসন্ধিক্ষণে একটি অস্থায়ী সরকার ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করেছিল। সেই সরকারের অধীনে কর্ণেল (তত্কালীন) এম.এ.জি ওসমানী দেশের সেনাপ্রধান ছিলেন। তার নেতৃত্বে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। দেশকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ চালানো হয়েছিল। প্রতিটি সেক্টরের দায়িত্ব একেকজন করে সেক্টর কমান্ডারের উপর ন্যস্ত ছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর (তত্কালীন) জিয়াউর রহমান। এসবই হলো জানা কথা।

মেজর (তত্কালীন) জিয়ার ভূমিকা অবশ্য অন্যান্য সেক্টর কমান্ডার থেকে তাত্পর্যপূর্ণভাবে কিছুটা বেশি ছিল। ২৭ মার্চে তিনি চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের একটি সচল ট্রান্সমিশন লাইন ব্যবহার করে স্বকণ্ঠে একটি ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। এজন্য তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রথম দফার ঘোষণায় তিনি নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি রূপে উল্লেখ করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বলে জানান। একবার মাত্র প্রচার হওয়ার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি তার বেতার বার্তার বক্তব্য কিছুটা পরিবর্তন করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন মর্মে উক্তিটি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে তিনি তখন বলেছিলেন যে, ‘মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে’ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি আরো বলেন যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে এবং তিনি তার অধীনে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। বেতারে এই বার্তা শুনতে পাওয়ায়, মুক্তিযুদ্ধের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা দেশবাসীর মনে সাহস ও প্রেরণার সঞ্চার হয়েছিল। অবশ্য তারও আগে, ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি ক্র্যাকডাউন ও গণহত্যা শুরুর পর, দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, বিডিআর ও সেনাবাহিনী তত্ক্ষণাত্ বিদ্রোহ করেছিল। এসব বিদ্রোহের ঘটনার কিছুটা পরে হলেও, মেজর জিয়ার ঘোষণা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল এ কারণে যে, একমাত্র তার বিদ্রোহের ঘোষণাটিই বেতারে প্রচার হয়েছিল। চট্টগ্রামের রেডিও ট্রান্সমিটারটি আগেই স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক ও অন্যান্য শক্তি দখল করে নিতে সক্ষম হওয়ায় চট্টগ্রামে ডিউটিরত মেজর জিয়া একপর্যায়ে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই দখলে থাকা বেতার কেন্দ্র থেকে সরাসরি ও স্বকণ্ঠে বক্তব্য প্রচারের সুযোগ পেয়েছিলেন। যা অন্যরা পায়নি। এরপর, গোটা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ও তার পরবর্তীতে মেজর জিয়া, সৈয়দ নজরুল ইসলাম-তাজউদ্দিন প্রমুখের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে এবং কর্ণেল ওসমানীর নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক প্রতিরোধে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেছিলেন। এসবও ইতিহাসের জানা কথা। কিন্তু ইতিহাসের এসব জানা কথা নিয়েও সমপ্রতি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সব মহলকে অবাক করে দিয়ে দাবি করা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নয়, বরঞ্চ জিয়াউর রহমানই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। একই মহল থেকে এক নিঃশ্বাসে একথাও বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাও ছিল অবৈধ। যা আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তিমূল ও বৈধতাকে স্পর্শ করে।

এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি হলো— বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আইনগত ভিত্তি কি? কোন্ আইনের বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশ? ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত এদেশ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ। সে সময়কালে এদেশে পাকিস্তানের সংবিধান ও আইন-কানুন ছিল ষোল আনা প্রযোজ্য। মনে রাখা প্রয়োজন যে, সেই আইনগত ভিত্তির বিধানানুসারে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। তাকে ছিন্ন করেই (বিদ্রোহ করেই) বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই, বাংলাদেশের সৃষ্টির আইনগত ভিত্তির হদিস পাকিস্তানের আইনে খুঁজে লাভ নেই। তাকে খুঁজতে হবে প্রধানত দেশবাসীর ইচ্ছার অভিপ্রকাশের মধ্যে। যা ব্যক্ত হয়েছে দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাঝে। সেসব আন্দোলন-সংগ্রামের মাঝে অগ্রাধিকার সম্পন্ন হয়ে উঠেছিল গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের দাবি। সেই আন্দোলন-সংগ্রামের স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিণতিই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাছাড়া জনগণের ইচ্ছার অভিপ্রকাশ রূপে সংগঠিত বিপ্লব-বিদ্রোহ হলো সবচেয়ে শক্তিশালী আইন। আইনের আনুষ্ঠানিক পাঠচর্চায়ও একথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আইনগত ভিত্তির উত্স তাই খুঁজতে হবে এদেশের জনগণের গণসংগ্রামের বাস্তবতার মাঝে। বাস্তব সত্য কথাটি হলো, পাকিস্তানের আইনগত ধারাবাহিকতার ‘অবিচ্ছেদ’ (continuity) হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়নি। তা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পাকিস্তানের আইনী ধারাবাহিকতায় ‘ছেদ’ (discontinuity) ঘটিয়ে। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সত্যটি ভুলে গিয়ে শুধু ‘অবিচ্ছেদকে’ ভিত্তি করে কিংবা ‘অবিচ্ছেদ’ ও ‘ছেদ’-এই উভয় উপাদানকে অবলম্বন করে বাংলাদেশের জন্মের আইনগত ভিত্তি খোঁজার চেষ্টা হবে একটি গুরুতর ভ্রান্তি।

পাকিস্তানি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বড় রকম ‘ছেদ’ তথা discontinuity’র সূচনা ঘটেছিল পাকিস্তানি শাসকদের হাতেই। ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল জারিকৃত ঐতিহাসিক ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ বিষয়টি নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা আছে—

“যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচন করেন এবং যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে মিলিত হইবার জন্য আহ্বান করেন এবং যেহেতু এই আহূত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয় এবং যেহেতু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে, …এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়া, গণহত্যা করিয়া এবং অন্যান্য দমনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের পক্ষে একত্রিত হইয়া একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং নিজেদের মধ্যে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সেহেতু…”।

এভাবে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পাকিস্তানের সংবিধান ও আইন থেকে ‘ছেদ’ ঘটানোর পটভূমি ও যুক্তিসমূহ স্পষ্ট ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথমত, এই ‘ছেদ’ ঘটানোর আইনগত পটভূমি যে পাকিস্তানি শাসকরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল সে কথা এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাছাড়া এই ‘ছেদ’-এর কারণ হিসেবে এই যুক্তিও তুলে ধরা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণ ইতোমধ্যে বাস্তবে ‘বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে’।

এসব প্রেক্ষাপটের বিবরণ ও যুক্তির ভিত্তিতে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ বলা হয়েছে, “… সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম…”। এভাবেই ‘ছেদ’-এর পটভূমির ওপর অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আইনগত ভিত্তি রচিত হয়েছে।

‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ বলা হয়েছে— “আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ…. পারস্পরিক আলোচনা করিয়া… এতদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, …কর আরোপন ও অর্থ ব্যয়ন ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সকল কার্য করিতে পারিবেন।”

‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ আরো বলা হয়েছে, “আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।”

এই ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের’ ভিত্তিতে আইনসিদ্ধ ও বৈধভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এই আইনী কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়েই ও তাকে মান্য করেই সেক্টর কমান্ডারগণসহ দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে দেশ স্বাধীন করেছে। এই ঘোষণাপত্রকে অস্বীকার করা, অথবা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ হলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা। এর দ্বারা মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।

যারা জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে উপস্থাপন করতে মাঠে নেমেছেন তারা কেবল মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতিই করছে না, এর মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে নৈতিক ও আইনগত যৌক্তিকতার একটি মূল স্তম্ভকেই অস্বীকার ও ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে। সে যুক্তিটি হলো, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের ‘ইচ্ছার’ প্রতিফলনের আইনগত বৈধতার গণতান্ত্রিক ভিত্তির যুক্তি। স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল ‘জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের’ সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি দ্বারা নয়— এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বৈধতার স্বপক্ষে সবচেয়ে জোরালো ও একটি প্রধান ক্রেডেনসিয়াল। এর ফলেই বিদেশি মিত্র শক্তিগুলোকে আমাদের পক্ষে আনার এবং বিশ্ব জনমতকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসার পথ সহজ হয়েছিল। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের’ বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে জিয়াউর রহমানের মর্যাদা বাড়ানো যাবে না। জিয়াউর রহমানের অবদানকে ‘ইতিহাসের ইঞ্জিনিয়ারিং’ দ্বারা বড় বা ছোট কোনোটা করাই সঠিক নয় এবং তা সম্ভবও নয়। কিন্তু ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি মহল আজ সেই বিপরীতমুখী নিষ্ফল প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধু অবৈধভাবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বলে একই মহল অভিযোগ তুলেছে। তারা তাদের অভিযোগের স্বপক্ষে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের’ “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন”— এই মর্মে প্রদত্ত বক্তব্যকে যুক্তি হিসেবে দেখাচ্ছে। যদি ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে’ যুক্তি হিসেবে দেখানো হয় তাহলে ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু’— এ কথা অস্বীকার করার উপায় থাকে না। অথচ তারা সেটাকেই অস্বীকার করে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের’ দোহাই দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা ছিল অবৈধ’ বলে বলছেন। প্রকৃত সত্য হলো, ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারিতে ‘স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে’ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আইনানুগভাবে ‘সাময়িক সংবিধান আদেশ-১৯৭২’ জারি করা হয়। এই আদেশ দ্বারা পার্লামেন্টরি পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১২ জানুয়ারি সেই সাময়িক সংবিধান অনুসরণ করে পর্যায়ক্রমে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা হয়— (১) রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আবু সাদাত মো. সায়েমকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন, (২) নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথবাক্য পাঠ করান, (৩) এর পরপরই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন, (৪) মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং প্রধান বিচারপতি তাকে শপথবাক্য পাঠ করান, (৫) তাজউদ্দিন আহমেদসহ গোটা মন্ত্রিসভার সদস্যগণ পদত্যাগ করেন, (৬) রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন এবং ১২ জানুয়ারি অপরাহ্নে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, (৭) পরদিন, ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি ১১ সদস্যের মন্ত্রী পরিষদকে নিয়োগ দান করেন। উপর্যুক্ত সবগুলো কাজই বৈধভাবে প্রণীত ‘সাময়িক সংবিধান আদেশ-১৯৭১’-এর ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছিল। তাহলে, বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাকে অবৈধ বলা যায় কি ভাবে?

একথা তাই পরিষ্কার যে, কে স্বাধীনতার ঘোষক, কিংবা কে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন তা নিয়ে বির্তক তোলাটা অসত্ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। এর দ্বারা শুধু দেশের সামনে প্রধান-প্রধান যেসব সমস্যা ও ইস্যু— সেগুলো আড়াল করার অপচেষ্টা কার্যকর হবে। এই ক্ষতিকর প্রয়াস বাদ দিয়ে অন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা তোলাটা বরঞ্চ কাজের কাজ হবে। যেমন কিনা, ‘অবিচ্ছেদ’ (continuity) ও ‘ছেদ’ (discontinuity)-এর বিষয় নিয়ে গভীর ও মূল্যবান আলোচনা মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী সম্পর্কে আমাদের অনেক ধারণাকে স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend