পরিবর্তন আসছে সামাজিক নিরাপত্তায়


পরিবর্তন আসছে সামাজিক নিরাপত্তায়

বদলে যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী। ধীরে ধীরে এক ছাতার নিচে আসছে বিদ্যমান ১৪৫টি কার্যক্রম। সেই সাথে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং বিনিয়োগকে উৎপাদনমুখী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এতে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের অন্যতম হাতিয়ার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে ইতিবাচক পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করছে এ বিষয়ে কাজ করা বেসরকারী সংস্থা সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)।

সংস্থাটি মনে করছে এ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো ও বাজেট বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান নয়, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।

জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে দ্য রিপোর্ট বলেন, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের লক্ষ্য হচ্ছে সকল যোগ্য বাংলাদেশির জন্য এমন একটি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা দারিদ্র্য ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করবে। বৃহত্তর মানব উন্নয়ন, কর্মের সুযোগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এছাড়া দক্ষতার সাথে ও কার্যকরভাবে সম্পদের ব্যবহার, সেবা প্রদান ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ও অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়ে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সংস্কার সাধনও এর উদ্দেশ্য। এতে করে সমাজের চরম দরিদ্র ও সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত সদস্যদের অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যকরভাবে জীবন চক্রের বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবেলা সম্ভব হবে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি অনুমোদন লাভ করেছে এই সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র। এর মাধ্যমে জীবনচক্রভিত্তিক সমন্বিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী প্রবর্তন করা হয়েছে। নতুন কৌশলপত্রে যেসব বিষয় যুক্ত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- অতিদরিদ্রদের জন্য ভিজিএফ, টিআর, কাবিখা ও বয়স্ক ভাতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি।

কৌশলপত্রে যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে তা হলো ‘লাইফ সাইকেল’। এতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে ‘লাইফ সাইকেল’ পদক্ষেপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মোট পাঁচটি লাইফ সাইকেল চালু করা হবে। অতিদরিদ্র, ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতিবন্ধী সবাইকে এই লাইফ সাইকেলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রথমত, সারা দেশে শূন্য থেকে চার বছর বয়সী পর্যন্ত যেসব অতিদরিদ্র, প্রতিবন্ধী ও ক্ষতিগ্রস্ত শিশু ও পরিবার রয়েছে তাদের প্রতি পরিবারকে নিদিষ্ট হারে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। দ্বিতীয়ত, পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সী যারা রয়েছে, তাদের মাসিক নির্দিষ্ট হারে টাকা দেওয়া হবে। তৃতীয়ত, ১৯ থেকে ৫৯ বছর বয়সী যাঁরা অতিদরিদ্র, ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতিবন্ধী তাদের নির্দিষ্ট হারে টাকা দেওয়া হবে। চতুর্থত, যাদের বয়স ৬০ থেকে ৮৯ তাদেরও নির্দিষ্ট হারে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। পঞ্চমত, যাদের বয়স ৯০-এর ওপরে তাদের মাসে নির্দিষ্ট হারে টাকা দেওয়া হবে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার যা নির্ধারণ করে দেবে তাই প্রযোজ্য হবে।

কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, পাঁচটি লাইফ সাইকেল একসঙ্গে বাস্তবায়িত হবে না। পাঁচ বছরে তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হবে।

সূত্র জানায়, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করতে ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আনতে এই কৌশল হাতে নিয়েছে সরকার। বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়ন হবে তিন পর্যায়ে। প্রথম পর্যায় প্রারম্ভিক একত্রীকরণ ও সমন্বয় অংশ হবে ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায় সমন্বয় সাধন ও বাস্তবায়ন অংশ হবে ২০২১ সাল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত এবং তৃতীয় পর্যায় জীবনচক্র কর্মসূচী ও অন্যান্য কর্মসূচীর সমন্বয় অংশ হবে ২০২৬ সালের পরবর্তী সময়ে।

সুপ্র মনে করে, বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ প্রতিবছরই বাড়ছে, এটি ইতিবাচক। যেমন, ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার ৬৮৯ (প্রস্তাবিত) কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ১১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা (প্রস্তাবিত), ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা (প্রস্তাবিত), ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ১৫ হাজার ৫১০ কোটি টাকা (প্রস্তাবিত) এবং চলতি (২০১৫-১৬) অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৬ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা (প্রস্তাবিত)। কিন্তু শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধিই মূল কথা নয়। সুবিধাভোগী নির্বাচন, বরাদ্দকৃত সুবিধা ন্যায্যভাবে প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সবসময়। এজন্য প্রয়োজন তৃণমূল জনগণের অংশগ্রহণে চাহিদা বিশ্লেষণ করে চাহিদাভিত্তিক বাজেটে বরাদ্দ দেয়া, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পরিকল্পনার আওতায় টেকসই কার্যক্রম বাস্তবায়ন। এছাড়া সুবিধাভোগীদের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মূল্যায়ন এবং শিক্ষণের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা, কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে জন অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী গ্রহণ ও বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। এছাড়া এসএমই ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে।

সূত্র জানায়, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের আওতায় আগামী পাঁচ বছরে (২০১৬-২০) সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা। অর্থবছর ১৬-তে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, অর্থবছর ১৭-তে প্রস্তাবিত বরাদ্দ হচ্ছে ৪৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, অর্থবছর ১৮-এ ৪৫ হাজার ৯১০ কোটি টাকা, অর্থবছর ১৯-এ ৪৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা এবং কৌশলপত্রের শেষ অর্থবছর ২০২০-এ ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৫১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।

সম্প্রতি সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সপ্তম পঞ্চ বার্ষিকসহ দীর্ঘমেয়াদে সব পরিকল্পনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দারিদ্র্য বিমোচনে। অব্যাহতভাবে এমন উদ্যোগ নেয়ার কারণে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ এখন উদাহরণ। আগামী দিনে অতিদারিদ্র্য নিরসনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বিছিন্ন এবং ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বিশেষ করে বেদে, দলিত সম্প্রদায়, হাওড়বাসী যারা অতিদরিদ্র তাদের জন্য আলাদা কর্মসূচী নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে। তবে এজন্য বিদেশী সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়িয়ে সেই ঘাটতি মেটাতে হবে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ঘোষণা করেছে। তবে একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, তা হচ্ছে বেশি লোককে না দিয়ে, প্রয়োজনে অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend