স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের প্রতিবেদন; সালাহ উদ্দিনের অপহরণ রহস্য উদ্ঘাটন দরকার

Salah-Uddin-Policeবিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের অপহরণ ও নিখোঁজের বিষয়টি ‘কথিত ও রহস্যজনক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা পুলিশের প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, ‘সরকারকে চাপের মধ্যে ফেলতে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম দিয়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়ে থাকতে পারে।’ এ নিয়ে দেশব্যাপী ধূম্রজালও সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
‘সালাহ উদ্দিন আহমেদের অপহরণের ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করা দরকার’ বলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদনে মতামত দেওয়া হয়েছে। ‘অপহরণের বিষয়টি উদ্ঘাটন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে’ বলেও ওই প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে।
১১ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ উত্তরার একটি বাসা থেকে সালাহ উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করে আসছেন তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা আহমেদ।
গোয়েন্দা পুলিশ, র‌্যাবসহ সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন পর্যন্ত সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আটকের কথা স্বীকার করেনি। তাকে খুঁজে বের করতে দেশের উচ্চ আদালতও সরকার ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। বিষয়টি নিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল ছাড়াও পেশাজীবী, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাসহ জাতিসংঘও উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু কোনো কূলকিনারা হয়নি এখনো।
সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ প্রসঙ্গে ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আগেও পুলিশ খুঁজছিল, এখনো খুঁজছে। তিনি আগেও আত্মগোপনে ছিলেন, এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘উনি (সালাহ উদ্দিন আহমেদ) আত্মগোপনে থেকে বিভিন্ন সময় তালেবানী পদ্ধতিতে সংবাদ মাধ্যমে বার্তা পাঠাতেন। আমরা আগেও তাকে খুঁজছিলাম, এখনো গোয়েন্দা পুলিশ তাকে খুঁজছে।’
১৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সে (সালাহ উদ্দিন) কোথায়, তার জবাব খালেদা জিয়াকেই দিতে হবে। সে তো ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ডে। ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে একটা করে স্টেটমেন্ট দেন। আমি যেদিন গেলাম, সেদিনও জানি, সালাহ উদ্দিন সেখানে (গুলশান)।’
তিনি বলেন, ‘ওখান (গুলশান কার্যালয়) থেকে ডিসিসি আট বস্তা ময়লা পেয়েছে। ওই ময়লার সঙ্গে তাকেও কোথাও পাচার করে দিয়েছে কিনা, সে জবাব খালেদা জিয়াই দিতে পারবে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। পুলিশ তাকে এ্যারেস্ট করার জন্য খুঁজছে।’
‘নিখোঁজ’ সালাহ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা পুলিশের এ প্রতিবেদন মঙ্গলবার হাতে আসে। প্রতিবেদনটি পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরা হল—
‘১১ মার্চ রাত পৌনে ১১টায় সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ উত্তরা পশ্চিম থানায় হাজির হয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) জানান, তার স্বামী সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ১০ মার্চ রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩-বি রোডের ৪৯/বি বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।’
প্রতিবেদনে ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, ‘উত্তরা পশ্চিম থানায় ১১ মার্চ রাতে হাসিনা আহমেদের কাছ থেকে তার স্বামী বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। তিনি থানার ওসিকে জানান, দুবাই থেকে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি তাকে ফোনে জানান, তার স্বামী সালাহ উদ্দিনকে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে। যে বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে গেছে সে বাড়িতে হাসিনা আহমেদ বাস করেন না। ঘটনার সময় তিনি সেখানে ছিলেনও না। তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি (নং-৬৩৪) করেন। ওসি হাসিনা আহমেদের মৌখিক বক্তব্য নোট নিয়ে ঘটনাস্থলে যান।’
‘প্রাথমিকভাবে জানা যায়, উত্তরা পশ্চিম থানার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩-বি রোডের ৪৯/বি তৃতীয় তলার বাড়ির মালিক মৃত ড. সিরাজ-উদ্দৌলা। বর্তমানে তার মেয়ের পক্ষে ধানমণ্ডির জনৈক রেজা বাড়ির তত্ত্বাবধান ও ভাড়া প্রদান করেন। ওই বাড়ির দারোয়ান আক্তার জানান, বাড়ির দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের ভাড়াটিয়া হাবিব হাসনাত চার দিন আগে সপরিবারে বাসা ছেড়ে চলে যান। তিনি যাওয়ার সময় রায়হান নামে এক মেহমান বাসায় রেখে যান। সেই ফ্ল্যাটে থাকা মেহমানের কাছে গাড়ি নিয়ে অন্য মেহমানরা আসা-যাওয়া করতেন। ১০ মার্চ রাত ৯টার দিকে চার-পাঁচজন মেহমান হাসনাতের বাসায় আসেন। আধাঘণ্টা পর রায়হান বাসায় আসা মেহমানদের সঙ্গে নিচে নেমে গাড়িতে করে চলে যান।’
‘আগত লোকদের মধ্যে কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে ছিল না। বাসা থেকে কাউকে জোর বা হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যেতে সে দেখেনি বলে জানায়। বাড়িটির কোনো ভাড়াটিয়াও ঘটনার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানায়।’ প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করার কোনো তথ্য পায়নি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাতের অন্ধকারে সালাহ উদ্দিনকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি ওই ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়ে তাকে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সালাহ উদ্দিনকে গ্রেফতারের কথা স্বীকার না করায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘অবিলম্বে সালাহ উদ্দিনকে আদালতে হাজির করতে হবে।’ দলটির বর্তমান মুখপাত্র বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সরকারের নিষ্ঠুরতার শিকার সালাহ উদ্দিন আহমেদ।’
পুলিশের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক স্টেট ডিপার্টমেন্টে অভিযোগ করেছেন, সালাহ উদ্দিনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই তুলে নিয়ে গেছে।’ অধ্যাপক ডা. এম এ মাজেদসহ এক হাজার ১০১ জন চিকিৎসক ও বিভিন্ন পেশাজীবীরাও সালাহ উদ্দিনের নিখোঁজে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ ১২ মার্চ হাইকোর্টে ‘মিস কেস’ দাখিল করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার স্বামীকে ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে আবেদন জানান। আদালত ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘কেন ১৫ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে সালাহ উদ্দিনকে হাজির করা হবে না’ মর্মে রুল জারি করেন।
প্রতিবেদনে সালাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে মোট ১৭টি মামলা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সালাহ উদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। হাসিনা আহমেদ তার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার যে সময় উল্লেখ করেছেন, তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও তিনি থানা পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেননি। উত্তরার যে বাসা থেকে তাকে অপহরণের কথা বলা হয়েছে, সেখানে হাসিনা আহমেদ কোনো দিন যাননি। এমনকি এ ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পরও তিনি সেখানে যাননি।’

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend