সরেজমিনে ঘুরে সংসদীয় কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন ‘পশু-পাখির জন্য কেনা মাংস যাচ্ছে চিড়িয়াখানার কর্মকর্তাদের পেটে’

image_161406.national_zoo_dhakaমাংস কেনা হয় পশু-পাখির জন্য। কিন্তু মাংস তাদের ভগ্যে জোটে না। তাদের ভাগে পড়ে হাড়-চামড়া। আর মাংস যায় কর্মকর্তাদের পেটে। এটা ঢাকা চিড়িয়াখানার চিত্র। সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য পেয়েছে সংসদীয় কমিটির তদন্ত টিম। এই কমিটি পশু খাদ্য ক্রয় থেকে শুরু করে চিড়িয়াখানার সব খাতেই অনিয়ম-দুর্নীতি খুঁজে পেয়েছে। সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পঁচা-বাসি খাবার খয়ে পশু-পাখিরা অসুস্থ্য হয়ে পড়লেও তাদের দেখার কেউ নেই। খাতায় হাজিরা থাকলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অফিসে পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে ঢাকা চিড়িয়াখানা আকণ্ঠ অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে দাবি করেছে সংসদীয় তদন্ত কমিটি।
সংসদীয় তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন নিয়ে আজ বুধবার মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি মীর শওকত আলী বাদশার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন কমিটির সদস্যরা। কমিটির পক্ষ থেকে চিড়িয়াখানাকে বাঁচাতে তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে উত্থাপিত প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি চিড়িয়াখানার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণসহ ১২ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে।
বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শওকত আলী বাদশা কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদীয় তদন্তে ঢাকা চিড়িয়াখার যে চিত্র পাওয়া গেছে তা খুবই খারাপ। এই অবস্থা থেকে প্রতিষ্ঠানটি বাঁচানোর জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সাব-কমিটি। আমরা সেই সুপারিশের সঙ্গে একমত। মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ বাস্তবায়নে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনিয়ম দুর্নীতির কারণে চিড়িয়াখানায় পশু-পাখির অবস্থা নাজুক। যে কারণে চিড়িয়াখানা দর্শনার্থী হারাচ্ছে। আর অনেক পশু-পাখি অকালে মারা যাচ্ছে। সেখানে মাংসাশি প্রাণীদের যে মাংস দেওয়া হয়, তাতে হাঁড়, পর্দা ছাড়া কিছুই থাকে না। মাংসগুলো আলাদা করে সরিয়ে নেওয়া হয়। মাংসগুলো যায় কর্মকর্তাদের পেটে। মাংসসহ পশুপাখির খাবার চালান ছাড়াই ক্রয় করা হয়। সাব কমিটি পরিদর্শনকালে খাদ্য ক্রয়ের কোনো চালান বা রশিদ দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করা হলেও প্রতিদিন কী পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে তার চালান-রশিদও পাওয়া যায়নি। যা সরকারি ক্রয় নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে কমিটি দাবি করেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চিড়িয়াখানা পরিদর্শনকালে মাত্র ৩০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাওয়া গেছে। বাকি ৭০ শতাংশ অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে হাজিরা খাতায় ঠিকই হাজিরা দেখানো হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে পশু-পাখিদের রাখা হয়। অসুস্থ্য হলে তারা সুচিকিৎসা পায় না। সেখানে নিরাপত্তার অভাবে রয়েছে। দর্শনাথীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন চিড়িয়াখানায়। শিশু খাদ্য, পানীয় ও ফাস্ট ফুড সরবরাহে অনিয়ম করতেই চিড়িয়াখানার ভেতরে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে সংসদীয় সাব কমিটি। বাইরের চাইতে ভেতরে যে কোন খাদ্যে বা পানীয় মূল্য দুই গুণ থেকে তিন গুণ বেশী। এক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হয় বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
তবে এসব অনিয়মের কথা অস্বীকার করে চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. এনায়েত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, সংসদীয় কমিটি অভিযোগ আনলে আমাদের মন্তব্য করার কিছু নেই। বিল-ভাইচার ছাড়া কোনো পশু-পাখির খাদ্য ক্রয় করা হয় না। তা ছাড়া মাংস ছাড়া হাঁড় পর্দা দেওয়ার অভিযোগ কতটুক যৌক্তিক তা না দেখলে বুঝাতে পারব না। আমারা এখানে পশু এনেই জবাই করি এবং তা সরাসরি পশু-পাখিকে দিয়ে থাকি। খাতায় হাজিরার বিষয়ে তিনি বলেন, যে দিন পরিদর্শনে এসেছিলেন, সেদিন শুধু একজন ড্রাইভার অগ্রিম হাজিরা দিয়েছিল। কারণ সে সব সময় আসতে পারে না। তাই অনেক সময় এটা করে থাকে। তারপরও আমরা তাকে শোকজ করেছি।
কিন্তু তদন্ত কমিটির মতে, এই পশু খাদ্য ক্রয় অনিয়মের হোতা জ্যু অফিসার মো. কামীম হোসেন ও কেয়ারটেকার মো. সালাউদ্দিন। এই অনিয়ম ধামা চাপা দিতে ঢাকা চিড়িয়াখানা প্রাণী খাদ্য কমিটির চেয়ারম্যান ড. মাকছুদুল হাসান হাওলাদার এবং জ্যু অফিসার শামীম হোসেন কাজ করেন। এই দুজনকে সরাতে পারলেই ৬০ শতাংশ দুর্নীতি কমানো যাবে।
কমিটির সূত্রে জানা যায়, ঢাকা চিড়িয়াখানায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। নবম সংসদে নানা পদক্ষেপ নিয়েও তা বন্ধ করতে পারেনি সংসদীয় কমিটি। দশম সংসদে স্থায়ী কমিটি গঠনের পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। গত ৩১ আগস্ট কমিটির তৃতীয় বৈঠকে ওই অভিযোগ তদনেত্ম কমিটির সদস্য কামাল আহম্মেদ মজুমদারকে আহ্বায়ক করে একটি সাব কমিটি গঠণ করা হয়। সাব কমিটিতে ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার (পিন্টু) ও খন্দকার আজিজুল হক (আরজু) সদস্য হিসেবে ছিলেন। সাব কমিটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে। এ সময় ঢাকা চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. এনায়েত হোসেনকে পাওয়া যায়নি।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend