ডাক বিভাগ ও বাংলাদেশ

দেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সচল প্রতিষ্ঠান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে না চলার অভাবে কিভাবে অচল প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত হয় বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তার একটি জলন্ত দৃষ্টান্ত।
প্রতিষ্ঠানিক ভাবে উপমহাদেশে সর্ব প্রথম ডাক সেবা চালু করা হয় ১৭৭৪ সালে। ব্রিটিশ ভারতে প্রথম ডাক বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। স্থায়ীভাবে প্রথম ডাক টিকিট চালু করা হয় সিন্ধুতে ১৮৫২ সালে। ১৮৭৮ সালে ঢাকায় সদর দপ্তর করে ইষ্ট বেংগল পোষ্টাল সার্কেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত ভারতে আসাম বেংগল পোষ্টাল সার্কেল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৫ সালে ঢাকার সদর ঘাটে স্থাপিত হয় প্রথম জি পি ও। ১৯৫০ সালে ঢাকার সদর ঘাট থেকে গুলিস্তানে জিরো পয়েন্টে জি পি ও স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৬২ সালে অপারেশনাল কার্যক্রমের লক্ষ্যে ৩ তলা ভিত্তির উপর বর্তমান জি পি ও ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৬ মে যশোরের শার্শা উপজেলায় সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম কাশিপুরে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রথম ডাকঘর স্থাপন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ কালীন প্রবাসী সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের প্রথম ডাক টিকিট ( ৮ টি ডাক টিকিটের ১ টি সেট) প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ” সেবাই আদর্শ ” স্লোগানে বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেভাবেই তার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠান টি যখনই সেবা কার্যক্রমে কিছুটা আস্থা হারাতে শুরু করে তখনই বেসরকারি উদ্যোগে ১৯৮৩ সালের দিকে সুন্দরবন কোরিয়ার ডকুমেন্টস সার্ভিস নামে প্রথম বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু হয়। এবং এর পরপরই কন্টিনেন্টাল কোরিয়ার, করতোয়া কোরিয়ার, এস এ পরিবহন থেকে শুরু করে বর্তমানে ২ শতাধিকের বেশি বেসরকারি কোরিয়ার সার্ভিস চালু হয়েছে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ধুকে ধুকে মৃতের দিকে যাচ্ছে। এবং প্রতিবছর ভর্তুকি দিয়ে চলতে হচ্ছে। বর্তমানে একটি চিঠি বা ডকুমেন্টস বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মাধ্যমে প্রেরণ করতে খরচ হয় মাত্র ৫ টাকা এবং সেই একই ডকুমেন্টসই যদি বেসরকারি কোরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রেরণ করতে খরচ হয় ৪০ টাকা অর্থাৎ সরকারি খরচের ৮ গুন। তবুও দেশের অধিকাংশ মানুষ ৫ টাকায় সরকারি ডাক বিভাগের সেবা না নিয়ে বেসরকারি কোরিয়ার সার্ভিসের ৪০ টাকা ব্যয় করে সেবা নিচ্ছে। আমার জানা মতে বেসরকারি কোরিয়ার সার্ভিসে সরকারি ডাক বিভাগের মতো ক্যাডার সার্ভিসের মেধাবী কোন কর্মকর্তা কর্মচারী নেই। তবুও কেন দেশের মানুষ সরকারি ডাক বিভাগের সেবা না নিয়ে বেসরকারি কোরিয়ার সার্ভিসের সেবা গ্রহণ করছে? এর উত্তর হয়তো অনেকেরই জানা।
আমাদের দেশের বেসরকারি কোরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থাপনায় যে পরিমাণ ডকুমেন্টস এবং পন্য পরিবহন হয় সেই সার্ভিস টি যদি বাংলাদেশ ডাকবিভাগ নিজে করতে পারতেন তাহলে বছরে কত হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব কোষাগারে যেত ? সেটা কয়েক হাজার কোটি টাকা। অথচ এই সার্ভিস টি দেওয়ার মতো বাংলাদেশ ডাকবিভাগের সক্ষমতা, জনবল সবই ছিলো শুধু মাত্র সদিচ্ছার অভাবের কারণেই বাংলাদেশ ডাকবিভাগ প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেসরকারি কোরিয়ার সার্ভিস যদি সারাদেশে তাদের অফিস ভাড়া নিয়ে এবং নিজস্ব জনবলের বেতন ভাতা দিয়ে বছরে কোটি কোটি টাকা লাভ করতে পারে বাংলাদেশ ডাকবিভাগ নিজস্ব জায়গায় সার্ভিস দিয়ে কেন লাভ করতে পারছে না? বাংলাদেশ ডাক বিভাগ যদি বেসরকারি কোরিয়ার সার্ভিসের মতো প্রত্যেক পার্সেল/ ডকুমেন্টস বুকিং এবং ডেলিভারির জন্য ১ টাকা বা আনুপাতিক হারে বরাদ্দ রাখতেন তাহলে প্রত্যেক পোস্ট অফিসের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো যে, কে কত বেশি পার্সেল / ডকুমেন্টস বুকিং এবং ডেলিভারি দিতে পারে। এতে করে প্রত্যেক পোস্ট অফিসের সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ অনেক বেশি পরিমাণ রাজস্ব পেত। সারা বিশ্ব ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করায় চিঠি আদান প্রদানের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ডাক বিভাগ আরও কিছু বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিতে পারে যেমন, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, গ্যাস বিল প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রদান থেকে শুরু করে অর্থাৎ যত ধরনের নাগরিক সেবার বিল আছে সবই ডাক বিভাগের মাধ্যমে নিতে পারে। এতে করে সারা দেশের নাগরিকগন কোন ধরনের হয়রানি ছাড়াই সর্বোচ্চ সেবা পাবে পাশাপাশি ডাকবিভাগ বাড়তি রাজস্ব আয় করবে। আসছে ফলের মৌসুমে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ যদি যুগোপযোগী এবং বাস্তব ধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে ফল পরিবহন করেই বাংলাদেশ ডাক বিভাগ খুব দ্রুত সময়ে লাভের মুখ দেখবে।
লেখক: প্রকৌশলী এম মোকাদ্দেছ বিল্লাহ (কাওছার)