স্বামী স্ত্রী একে অন্যের চোখে চোখে
স্বামী-স্ত্রী এখন পরস্পরকে বেশি করে চোখে চোখে রাখছেন। একে অন্যের ওপর নজরদারির হার এখন অনেক বেড়েছে। আর এ কাজ এখন সবচেয়ে বেশি হচ্ছে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে। টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঙ্গীকে চোখে চোখে রাখছেন না? শিগগিরই নিজেকে সংখ্যালঘুর দলে আবিষ্কার করবেন!
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন কেউ যদি সঙ্গীকে নজরদারি করার বিষয়টি অস্বীকার করেন, তবে দেখা যাবে অন্যদের ভ্রু কুঁচকে যাবে। প্রযুক্তির এই যুগে ‘জিপিএস’ কিংবা ‘ফাইন্ড মাই ফোন’ অপশন ব্যবহার না করাটাই এখন যেন সংখ্যালঘুর পরিচয়!
প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত তিন বছরে ‘স্পাই’ বা নজরদারি সফটওয়্যারের ব্যবহার বেড়েছে। সঙ্গীর গতিবিধি নজরদারি করতে এ ধরনের সফটওয়্যার বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘরের মধ্যে নজরদারির যন্ত্রপাতি লুকিয়ে, গাড়িতে ট্র্যাকার বসিয়ে, ফোনে টেক্সট ও মুছে ফেলা ই-মেইল পড়ার সফটওয়্যার যুক্ত করে দম্পতিরা এখন পরস্পরের ওপর নজরদারি করছেন।
সাম্প্রতিক এক গবেষণার ফল বলছে, মধ্যবয়সী দম্পতিদের প্রতি সাতজনের একজন পরস্পরের কাছে অর্থ আয়সংক্রান্ত তথ্য গোপন করেন এবং এদের এক-তৃতীয়াংশ আয়ের বিষয়ে মিথ্যা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিমা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান প্রুডেনশিয়ালের গবেষণা অনুযায়ী, অনেকেই সঙ্গীর কাছে আর্থিক বিষয়টি চেপে রাখেন। কারণ, তাঁরা পরবর্তী সময়ে নিজেদের জন্য কিছু কিনতে চান বা কোনো কারণে সম্পর্ক ভেঙে গেলে তা কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেন। এই বিষয়টি থেকে পরস্পরের ওপর নজরদারির আগ্রহ বেড়ে যায়। কার অ্যাকাউন্টে কত টাকা গোপন করা আছে, সেটিও নজরদারির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নজরদারির সফটওয়্যার
নজরদারির অধিকাংশ সফটওয়্যার কাজ করে স্থান বা লোকেশন নিয়ে। এখন খুব সাধারণ ফোনেও জিপিএস বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম প্রযুক্তি থাকে। দেখা গেছে, অধিকাংশ দম্পতিই পরস্পরের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড জানেন। অনেক সময় দেখা যায় কোনো কারণ থাক বা না থাক সঙ্গী পরস্পরের ওপর খুব সাধারণভাবে হলেও নজরদারি করতে থাকেন।
অনেক সময় স্বামী বাড়ি ফিরতে দেরি করলে স্ত্রী জিপিএস দিয়ে ট্র্যাকিং শুরু করেন। তাঁরা এটা করতে পারছেন কি না, শুধু সেটা দেখার জন্যও অনেক সময় এই নজরদারি করা হয়। অনেক সময় ফাইন্ড মাই কিডস বা ফ্যামিলি ট্র্যাকারের মতো অ্যাপস ব্যবহার করেও নজরদারি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাজারে জনপ্রিয় কয়েকটি নজরদারির অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে রয়েছে মোবাইল স্পাই, মোবাইল স্টেলথ, স্টেলথজিনি ও এমকাপল।
এমকাপল অ্যাপ্লিকেশনটির বর্ণনায় লেখা রয়েছে, ‘সঙ্গীর প্রেমে পাগল? আগের চেয়ে পরস্পর আরও বেশি কাছে থাকতে চান কিংবা কোনো কাজে বেশি দূরে চলে গেলে কী করবেন? এমকাপল মোবাইল ট্র্যাকার আপনাকে সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা কাছে থাকার সুযোগ করে দেবে।’ মাসে ২৫ থেকে ৫০ পাউন্ড পর্যন্ত খরচ করলে এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো আপনার সঙ্গীর মোবাইল ফোনে আসা যাওয়া সব বার্তা জানার সুযোগ করে দেবে। এমনকি পরস্পরের ফোনবুকের তথ্য এবং সঙ্গী ফেসবুকে কার সঙ্গে কখন চ্যাট করেছে, সে তথ্যও পাওয়া যাবে।
যুক্তরাজ্যে দম্পতিদের ওপর নজরদারি করার প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডি-টেক প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন। প্রতিষ্ঠানটি কারিগরি নজরদারিতে সহায়তা করে। যুক্তরাজ্যের শাফোকের জেন উইলিয়ামস তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘একজন লোকের সঙ্গে আমার পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিল। সে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রাখেনি। আমি ডি-টেকের বার্তা বিশ্লেষক ও গাড়ি ট্র্যাকিংয়ের সহায়তা নিয়েছিলাম। আমার কাছে এরপর পরিষ্কার হয়ে গেল যে ওই লোকটি বিবাহিত এবং দুদিকই সামলাচ্ছে।’
যুক্তরাজ্যের ডেডরি জে. নামের আরেক নারী বলেন, ‘আমার স্বামী সব সময় কম্পিউটার ব্যবহার করত। তাঁর ই-মেইল পরীক্ষা করার ও পাসওয়ার্ডগুলো জানার ইচ্ছা হলো। অনলাইনে এ-সংক্রান্ত কিছু সফটওয়্যার কেনা যায় বলে জানি কিন্তু আমার সাহস ছিল না। প্রথমত, এতে আমার স্বামীর দেখে ফেলার আশঙ্কা ছিল এবং দ্বিতীয় ইনস্টল করার সময় আমি লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলতাম। এ ক্ষেত্রে ডি-টেকের কম্পিউটার প্রকৌশলীরা আমার হয়ে সব কাজ করে দিল। মাত্র ৩০ মিনিটেই সব আমি সব পেয়ে গেলাম।’
ডি-টেকের পরিচালক জো ক্লার্ক এ প্রসঙ্গে বলেন, আট বছর আগে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের গ্রাহক দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ক্লার্ক আরও বলেন, ‘আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন নারী গ্রাহক ছিল বেশি কিন্তু এখন সংখ্যা প্রায় সমান সমান হয়ে গেছে। একদিকে প্রযুক্তি মানুষকে যেমন বেশি প্রতারণা শেখায়, অন্যদিকে প্রতারণা ধরার বিষয়টিও অনেক সহজ করে প্রযুক্তির ব্যবহার।’
ক্লার্ক বলেন, আগে স্বামীর জামার কলারে লিপস্টিকের দাগ দেখে বা পকেটে সন্দেহজনক চিরকুট দেখে প্রতারণার বিষয়টি ধারণা করা হতো। কিন্তু এখন কয়েকটি বোতামের চাপেই তথ্য-প্রমাণ হাজির করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অবশ্য গ্রাহককে নজরদারি করার ফোনটি ব্যবহার করার ও নজরদারি করার অধিকার রাখতে হবে।
ডি-টেকের কাজ সম্পর্কে ক্লার্ক বলেন, ‘আমাদের তৈরি সফটওয়্যার সিম কার্ডের পরিবর্তে মোবাইল ফোনে ইনস্টল হয়, তাই সিম পরিবর্তন করলেও কাজ হবে না। মোবাইল ফোন থেকে পাঠানো বার্তা, ফোনকল, জিপিএস লোকেশন, ছবি, ক্যালেন্ডার, ওয়েবসাইট ব্রাউজের তথ্য, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ফেসবুক চ্যাট সব তথ্যই জানা যাবে। এমনকি মুছে ফেলা তথ্যও পড়ার সুযোগ রয়েছে।’
মানসিক কারণ
এ ধরনের নজরদারির মানসিক কোনো ব্যখ্যা আছে কি? ম্যারিটাল থেরাপিস্ট এবং মাই হাজবেন্ড ডাজ নট লাভ মি বইয়ের লেখব অ্যান্ড্রু জি মার্শাল বলেন, ‘প্রিয় সঙ্গীর ওপর গোয়েন্দাগিরির বিষয়টি মূলত নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে তৈরি হয়। নজরদারির বিষয়টি প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন আমরা করতে সক্ষম বলেই এর ব্যবহার বাড়ছে।’
নজরদারিও ফাঁকি দেওয়া যায়?
এত নজরদারির ভেতরেও অবিশ্বাস বা ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি বাড়ছে কী করে? নজরদারি ঠেকানোর কিছু ব্যবস্থাও এখন এসে গেছে। ব্ল্যাক বুক, মোবাইল ভল্ট বা ক্যাটের মতো বিভিন্ন সেবা রয়েছে, তা নজরদারি ঠেকিয়ে অনেক কিছু গোপন করতে পারে। ব্ল্যাক বুক সব নজরদারি ঠেকিয়ে মোবাইল ফোনে গোপন ফোন নম্বরের তালিকা রেখে দিতে পারে। ফোন কলের তথ্য কিংবা বার্তা নজরদারি এড়িয়ে মুছে ফেলতে পারে ক্যাট আর আইক্লাউডে মোবাইল ভল্ট সুগোপনে রেখে দিতে পারে স্পর্শকাতর তথ্য। তবে কী জেমস বন্ড স্টাইলের আধুনিক জীবনের শুধু প্রেমাভিনয় ছাড়া গতি নেই? সবচেয়ে ভালো হয়, মোবাইল ফোনটিকে অবিশ্বস্তার কারণ হতে না দিলে এবং মোবাইল ফোনটিকে দূরে সরিয়ে রাখলে।