মহানগরের স্পয়লার

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, লেখক

গতকাল বিকেলে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হলো; প্রায় পঁচিশ বছর আগে টিএসসির সবুজ ঘাসের ওপর বসে আড্ডা হয়েছিলো। ঠিক যেইখানে বন্ধুত্বটাকে রেখে এসেছিলাম আমরা; ঠিক সেখান থেকে শুরু হলো আমাদের কথা। এই যে প্রায় পঁচিশ বছরের অদেখা; তাতে সম্পর্কের উষ্ণতায় এতোটুকু ক্ষেদ নেই; বরং এই যে একজন আরেকজনকে ফিরে পাওয়া; তার মধ্যে একটা রেজুভেনেশান-রিনিউয়াল অফ ফ্রেন্ডশিপ যেন ঘটে গেলো।

আমার বন্ধু আন্তর্জাতিক কল্যাণ সংস্থার সঙ্গে বহুবছর কাজ করেছে; ফলে পুরো দক্ষিণ এশিয়া; এর সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীটা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। অবশ্য কোথাও না ঘুরে বইয়ের পৃষ্ঠা-চলচ্চিত্র সম্বল করে সেই টিএসসি কালেই এই বিশ্ববীক্ষা ওর ছিলো। পরে কেবল মিলিয়ে নিয়েছে হয়তো।

আজকের বাংলাদেশ সমাজটা ঠিক কোন জায়গায়; এ আলোচনা করতে না চাইলেও; তা কেন যেন এসে পড়ে। ধর্মীয় ও দেশপ্রেমের অনুভূতি টগবগ করে ফুটতে থাকায়; প্রকাশ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলারও উপায় নেই। তাই হোয়াটস এপের সবুজ ঘাসে; আমরা যেন সেই চিন্তার মুক্তাঞ্চল টিএসসি ডিকন্সট্রাক্ট করি।

সে বললো, সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং-এর আইকন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কীভাবে এই মোহরের রমরমা যুগেও সোন্নত সাহসে প্রজ্ঞাচর্চা করে গেলেন। তাদের গৃহের ড্রইং রুমের আসবাব; এখনো সেই বিটিভির সাদাকালো নাটকের সাদাসিধে আসবাব। সিং হাসনের মতো সোফাসেট; মুঘল দরবারের মতো পর্দা তাদের কখনোই প্রয়োজন হয়নি। আমরা এই ডায়াজিনিজদের ছাত্র ছিলাম; সেই আনন্দ উদযাপন করলাম দুজনে।

এক-আধটু আলোচনা হলো খুশিজল নিয়ে; আমি এই অনাবাসে কথিত ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রেসক্লাবের দোতলার পাবে খুশি পরিসেবা করি মাঝে সাঝে-অর্ডার করলে ঠিক ফুড পান্ডার মতো খুশিজল পান্ডা ঘরের দরজায় দিয়ে যায়; অথচ কথিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার লিপ সার্ভিস দেয়া গণপ্রজাতন্ত্রে খুশিজল নিয়ে বড্ড ঢাক ঢাক গুড় গুড়। কেমন যেন পরাবাস্তব মনে হয় এরকম উল্টোরথের অভিজ্ঞতা।

কলকাতা-করাচি-বোম্বে-দিল্লি-ইসলামাবাদে মেয়েরা রাতে একা ঘুরতে পারে। নানা ঘটনা-অঘটনের মাঝ থেকে শিক্ষা নিয়ে ওসব সমাজ নারীর নিরাপত্তা দিতে সচেষ্ট হয়েছে। আমরা ঢাকায় কতটা পেরেছি; সে প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মাথায়।

আমার বন্ধু কিছু টেলিফিল্মে অভিনয়ও করেছে। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় টেলিফিল্ম পরিচালকদের সগে শিডিউল মেলাতে না পারায় অভিনেতা হিসেবে তার উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে একপাশে ফেলে রেখেছে সে। এখন যেহেতু ওটিটির যুগ; আমাদের অনেক অনুজ প্রতিম নির্দেশক কাজ করছেন; তারা হয়তো ঠিকই আবার ওকে অভিনয়ের জগতে ফিরিয়ে আনবে। ওর সুবিধা হচ্ছে; সে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল একজন অভিনেতা। একজন প্রজ্ঞাবান অভিনেতা খুঁজতেন সত্যজিত রায়ের মতো প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রকার। কারণ এতে অভিনেতা তার চরিত্রটিকে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন; নির্ভুল-নিখুঁত অভিনয়ের জন্য তিনি শতভাগ উজাড় করে দিতে পারেন।

কথা প্রসঙ্গে আশফাক নিপুণের মহানগর সিরিজের কথা এলো। সে এই সিরিজকে দশে দশ দিলো। আমাদের এই শান্তিপ্রিয় সমাজে যেসব চরিত্র তাদের আধিপত্য কায়েম করে একে ভয়ংকর বিপজ্জনক করে তোলে; তার অনুপুংখ বর্ণনা এসেছে এই নাটকে। এই সিরিজ দর্শককে ধরে রেখেছে। স্ক্রিনের গ্রিপে দর্শককে ধরে রাখার মাঝেই নির্মাতার মুন্সীয়ানা। আশফাক নিপুণ সেক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল। আর তার সমাজ-রাজনৈতিক সচেতনতা; জনমানুষের জন্য একটি সভ্য বসবাসযোগ্য সমাজের আকাংক্ষা প্রতিভাত হয়েছে এই সিরিজে।

বন্ধুর সঙ্গে আশফাক নিপুণের সাফল্য উদযাপন করে ফেসবুকের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখি; তার দেশপ্রেম ও চেতনা নিয়ে টানাটানি করছে লিলিপুটিয়ান ও ব্লেফুসকুডিয়ানরা। সহমত ভাই ফেসবুকের ডেসমন্ড টুটু তাকে বিএনপি আমল নিয়ে নাটক বানানোর হুকুম দিচ্ছে। সহমতেল বাল্টন তার চেতনা ঠিক নাই বলে ফতোয়া দিচ্ছে। শাহবাগ আন্দোলনে যোগ দিলেও তার চেতনার ইমান মজবুত নয়; মাথা নাড়িয়ে এমন রায় দিচ্ছে দেশপ্রেমের ম্যানেজারেরা।

অন্যদিকে ধর্মের ম্যানেজারেরাও পিছিয়ে নেই, আশফাক নিপুণ কীভাবে শাহবাগ আন্দোলনে গিয়ে ধর্মের ইমান হারিয়েছে; অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ধারণ করে কীভাবে সহমত ভাইদের দলে নাম লিখিয়েছে; ফলে তাকে বিশ্বাস করা যায়না। তার নাটক দেখুম না বলে তীব্র আস্ফালন করছে।

ভারত-পাকিস্তানে সরকারের কোলধরা লোকজন, ধর্মের ভংধরা লোকেরা সংস্কৃতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। অথচ বাঙালি সংস্কৃতি সচেতন বলেই কীনা জানিনা; এখানে সহমতেল কিংবা ধর্মতেল; সবাই লেগে পড়েছে “মহানগর” নাটকের স্পয়লার দিতে।

আমি কিন্তু বেশ খুশি; যেভাবেই হোক অপসংস্কৃতির লোকেরা সংস্কৃতির আলোচনায় এনগেজড হচ্ছে; আর কী চাই!

দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট লিখেছেন, সত্য যাদের মৃত্যু ঘটায়; ওদের মরে যেতে দাও।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend