বাস্তবায়িত হয়নি সেতুমন্ত্রীর ৪ লেনের ঘোষণা: সিরাজগঞ্জে ৪৮ ঘণ্টায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৫

Sirajgonj-ho-সিরাজগঞ্জে গত ৩ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত এবং নারী-শিশুসহ আহত হয়েছে কমপক্ষে ৬০ জন। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ সড়কের প্রায় একই স্থানে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি নিয়ে স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম এলাকা থেকে নলকা পর্যন্ত মহাসড়কটি ১৯ লেনের দাবি দীর্ঘদিনের। যোগাযোগ ও পরবর্তী সময়ে সেতুমন্ত্রী যতবার সিরাজগঞ্জে এসেছেন ততবারই ১৯ কিলোমিটার মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এখনও সে কাজ শুরু হয়নি। স্থানীয়রা জানান, ৪ লেনে উন্নীত না হওয়ায় একই স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪৮ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় মহাসড়কের প্রায় একই স্থানে ৩টি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রথম দিনে ২ জন, দ্বিতীয় দিনে ১০ জন এবং তৃতীয় দিনে ৩ জনসহ মোট ১৫ জন নিহত হয়েছেন।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী একটি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ন ১১-৯২১৪) বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম কোনাবাড়ি এলাকায় আকস্মিকভাবে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে পার্শ্বের খাদে উল্টে যায়। এতে চালক পাবনার ঈশ্বরদীর জগন্নাথপুর গ্রামের আলআমিন মল্লিকের ছেলে আজিজ মল্লিক (৩০) এবং পার্শ্ববর্তী মোক্তারপুর গ্রামের সত্য কারিগরের ছেলে আদম আলী ঘটনাস্থলেই মারা যান। লাশ উদ্ধার করে পুলিশ বঙ্গবন্ধু সেতু থানায় রাখলে পরে স্বজনরা নিয়ে যায়। পরের দিন শনিবার বিকেল ৩টার দিকে কোনাবাড়ি সীমান্তবাড়ি এলাকায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৪৫ জন আহত হয়।

বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন জানান, ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলগামী টিনবোঝাই একটি ট্রাক ঢাকা (মেট্রো-ট-১১-৯৪৫৩) বঙ্গবন্ধু সেতু পেরিয়ে পশ্চিম সংযোগ সড়কের কামারখন্দ উপজেলার কোনাবাড়িতে পৌঁছলে সামনের চাকা বিস্ফোরিত হয়ে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এ সময় গাইবান্ধা থেকে ঢাকাগামী অন্তর পরিবহন নামের একটি কোচের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। একই সময়ে নাবিল এন্টারপ্রাইজের অপর একটি কোচ পিছন থেকে দুর্ঘটনাকবলিত অন্তর পরিবহনের কোচকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ৬ জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৪ জনসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়। হতাহতরা সবাই অন্তর এন্টারপ্রাইজের যাত্রী। নিহতদের মধ্যে ট্রাকচালক সোহরাব আলী এবং হেলপার আফসার উদ্দিনের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলায়। তবে অন্যদের পরিচয় জানা যায়নি। আহতদের তাৎক্ষণিক সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। এ সময় আহতদের কয়েজনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। তারা হলেন— গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার সাইফুর রহমান (৩০), আনিসুর (২০), সবুজ (১৮), কচুয়া গ্রামের সেন্টু সেখের ছেলে রেজাউল (৪০), পলাশপুর উপজেলার জামালপুর গ্রামের শাহ আলম (৩৫), জয়পুরহাটের কালাই থানার মাতরাই গ্রামের রুহুল আমিন (৩১), কায়সার (৪২), তৈয়বুর (৩৫), জবিপুর গ্রামের লিটন (২৫), জিগালা উত্তরপাড়া গ্রামের বেলাল (৩০), বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার আড়িমহন গ্রামের আলম, খড়গাড়া গ্রামের আ. হালিম (১৭) ও কাহালু উপজেলার গোয়ালিয়া গ্রামের এনামুল (২৪)।

এদিকে শনিবারের শোকের মাতম কাটতে না কাটতেই রবিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আবারও দুর্ঘটনা ঘটে। এটিও বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় মহাসড়কে, পূর্বে ঘটিত দুর্ঘটনার কাছাকাছি। রবিবারের দুর্ঘটনায় বাবা-ছেলেসহ ৩ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়েছে। আহতদের সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ এক জনকে আটক করেছে। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানা পুলিশ জানান, ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী একটি দাঁড়িয়ে থাকা মিনি ট্রাককে (ঢাকা মেট্রো-ট-১৬-৪২৯১) পেছন থেকে অপর একটি বড় ট্রাক যশোর-ড-১১-০৩২৭ সজোরে ধাক্কা দিলে মিনি পিকআপটি উল্টে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এ সময় ট্রাকে থাকা বাবা-ছেলে ও চালকসহ ৩ জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। নিহতরা হলেন— ট্রাকচালক পাবনা সদর দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর মহল্লার মৃত মেছের খানের ছেলে শফি খান (৫২), ট্রাকে থাকা বগুড়া জেলার ধুনট থানার মাধবডাঙ্গা গ্রামের তফিজ উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে দুদু মিয়া (৪৮) এবং দুদু মিয়ার ছেলে হৃদয় মিয়া (৯)। এ সময় অপর ট্রাকের দু’জন আহত হয়। এ ঘটনার পর ট্রাকচালক পালিয়েছে। নিহতের লাশ বঙ্গবন্ধু সেতু থানা থেকে পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সিরাজগঞ্জ-কামারখন্দ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না এমপি, জেলা প্রশাসক মো. বিল্লাল হোসেন, সিভিল সার্জন ডা. শামসুদ্দিন, দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও হাসপাতালে চিকিৎসার খোঁজ নেন।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফরিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাতে কয়েজনের স্বজন লাশ বাড়িতে নিয়েছে। মর্গে এখনও কয়েকটি লাশ আছে।

গত ৪৮ ঘণ্টায় মর্মান্তিক এ সকল সড়ক দুর্ঘটনায় সিরাজগঞ্জের কেউ না থাকলেও সিরাজগঞ্জবাসী গভীর উদ্বিগ্ন। অনেকে মনে করছেন বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে সিরাজগঞ্জ হাটিকুমরুল পর্যন্ত লেনের রাস্তা তৈরি না করাই এ সকল দুর্ঘটনার কারণ। আবার কেউ কেউ মনে করছেন অতিমাত্রায় গতি এবং রাতে তন্দ্রাচ্ছন্নতার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে হাটিকুমরুল গোলচত্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫টি সংযোগ সড়ক থাকাতেও দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় চালক তার গাড়ির গতি রোধ করতে না পেরেও দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন। সেতুর পশ্চিমপাড় এলাকার সায়দাবাদ মোড়, মুলিবাড়ি রেলক্রসিং, কড্ডামোড়, কোনাবাড়ি, নলকা, পাঁচলিয়াসহ একাধিক স্থানে ওভারব্রিজ নির্মাণের জন্য জোর দাবি করা হলেও তেমন কোন সাড়া মেলেনি।

সচেতন সিরাজগঞ্জবাসী মনে করেন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করার পর থেকেই এ মহাসড়কে যানবাহন বেড়েছে। শুধু উত্তরবঙ্গ না দক্ষিণের শত শত যান চলাচল করে এ সড়কেই। সেতুমন্ত্রীর একাধিকবার লেনের বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে কোন কাজ এখনও চোখে না পড়াতে পুরো উত্তরবঙ্গবাসী বিস্মিত। তাই দ্রুত ৪ লেনের সড়ক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে সরকার পদক্ষেপ নেবে এমনটাই সকলের দাবি।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend