রবীন্দ্রনাথের গানে বুদ্ধ : চেতনা ও দর্শন

article-in-rabindranath-forতপন বাগচী
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিবিশ্বে ও চেতনাবিশ্বে গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মে প্রভাব নানানভাবে লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধ কাহিনী নিয়ে তিনি বেশ কিছু কবিতা ও নাটক রচনা করেছেন। তাঁর গানেও পাওয়া যায় বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের উপকরণ। বুদ্ধদেব নিজেকে দেবতা কিংবা ঈশ্বর প্রেরিত বলে প্রচার করেননি। তিনি নিজেকে ‘মানবপুত্র’ বলেই মনে করতেন। মানবপুত্র বুদ্ধদেবের প্রতি রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আর কোনো ধর্মগুরুর প্রতি রবীন্দ্রনাথকে এতটা ভক্তিপূর্ণ মনে হয়নি। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ না করলেও বুদ্ধের আদর্শকে তিনি গ্রহণ করেছেন, বুদ্ধের বাণীকে তিনি প্রচার করেছেন। ‘বুদ্ধদেব’ নামে একটি গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন।
ওই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন,
‘ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব মানবকে বড় করিয়াছিলেন। তিনি জাতি মানেন নাই, যাগযজ্ঞের অবলম্বন হইতে মানুষকে মুক্তি দিয়াছিলেন, দেবতাকে মানুষের লক্ষ্য হইতে অপসৃত করিয়াছিলেন। তিনি মানুষের আত্মশক্তি প্রচার করিয়াছিলেন। দয়া এবং কল্যাণ তিনি স্বর্গ হইতে প্রার্থনা করেন নাই, মানুষের অন্তর হইতেই তাহা তিনি আহ্বান করিয়াছিলেন।
এমনি করিয়া শ্রদ্ধার দ্বারা, ভক্তির দ্বারা, মানুষের অন্তরের জ্ঞান শক্তি ও উদ্যমকে তিনি মহীয়ান করিয়া তুলিলেন। মানুষ যে দীন দৈবাধীন হীন পদার্থ নহে, তাহা তিনি ঘোষণা করিলেন।” (বুদ্ধদেব, পৃ. ৪৮)
গৌতম বুদ্ধের শাশ্বত কল্যাণের বাণী তিনি বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছে তাঁর গানে, কবিতাও ও নাটকের মাধ্যমে। বুদ্ধের স্মৃতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি বুদ্ধগয়ায় যেতেন। একাকী গেছেন। সপরিবারও গেছেন। সেখানেই বসে তিনি ধ্যান করেছেন। সেখানে বসে তিনি গানও রচনা করেছেন। একটি গানে তিনি পুনরাগমনের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি আবার এই জ্ঞান-সাগরের তীরে ফিরে আসতে চেয়েছেন। আবার তিনি ধূলিমাটির পৃথিবীতে ফিরে আসতে চেয়েছেন। মায়ার পৃথিবীতে ফিরে আসার এই আকুতিই ফুটে উঠেছে তাঁর গানের চরণে—
আবার যদি ইচ্ছা কর
আবার আসি ফিরে
দুঃখসুখের ঢেউ-খেলানো
এই সাগরের তীরে।
আবার জলে ভাসাই ভেলা,
ধুলার পরে করি খেলা,
হাসির মায়ামৃগীর পিছে
ভাসি নয়ন-নীরে ।

[ গীতালি ৮৬ ]
দ্বিতীয়বার বুদ্ধগয়াতে গিয়েও রবীন্দ্রনাথ গান লেখেন। তিন দিনের অবস্থানকালে তিনি প্রায় ১০টি গান রচনা করেন। এর সবই প্রায় স্থান পায় ‘গীতালি’ কাব্যে। এগুলো পূজাপর্বের গান হিসেবেও পরিচিত। বুদ্ধের চরণতলে সন্ধ্যাতারার ফুল দিয়ে নৈবেদ্য সাজানোর কথা কবি কল্পনা করেছেন। বুদ্ধের চরণতল কবি চোখের জলে ধুয়ে দেওয়া আকুতি প্রকাশ করেছেন। এই একটি উক্তি থেকেই বোঝা যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মহামতি বুদ্ধদেবের প্রতি কতটা অনুরক্ত ছিলেন! গানের বাণীটি এ রকম—
সন্ধ্যাতারা যে ফুল দিল
তোমার চরণ-তলে
তারে আমি ধুয়ে দিলেম
আমার নয়নজলে।
বিদায়-পথে যাবার বেলা ম্লান রবির রেখা
সারা দিনের ভ্রমণ-বাণী লিখল সোনার লেখা,
আমি তাতেই সুর বসালেম
আপন গানের ছলে।

[ গীতালি ৮৯ ]
‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ গানটিও বুদ্ধগয়ায় বসে রচিত। বুদ্ধকে তিনি বিশেষভাবে ধারণ করেছেন বলেই দুইবার গেছেন বুদ্ধগয়ায়। প্রতিবারই তিনি বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন পরম আন্তরিকতায়। নিবেদন করেছেন হৃদয়ের অর্ঘ্য। আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের যত আত্মনিবেদনের গান, তার প্রায় সকল স্থানেই রয়েছে গৌতম বুদ্ধের বাণী ও দর্শনের প্রকাশ। কখনো তা পরোক্ষ, কখনো তা প্রত্যক্ষ হয়ে ফুটে উঠেছে।
বুদ্ধদর্শন ও বুদ্ধচেতনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে সকল গান লিখেছেন, তার একটি আংশিক তালিকা প্রস্তুত করা যেতে পারে—
১. অন্তর মম বিকশিত কর
২. অন্ধজনে দেহ আলো মৃতজনে দেহ প্রাণ
৩. আজি মম মন চাহে জীবন বন্ধুরে
৪. আমার বিচার তুমি করো তবে আপন করে
৫. এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ
৬. চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি
৭. জীবন যখন শুকায়ে যায়
৮. ডাকছি শুনি জাগিনু প্রভু, আসিনু তব পাশে
৯. ডাকিছ কে তুমি তাপিত জনে
১০. তোমার রাগিণী জীবনকুঞ্জে
১১. তুমি বন্ধু তুমি নাথ, নিশীদিন তুমি আমার
১২. তোমারি সেবক করো হে
১৩. তোমারই ইচ্ছা পূর্ণ হইক
১৪. দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া
১৫. দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে
১৬. দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক
১৭. দুঃখের বেশে এসেছ বলে তোমায় নাহি ডরিব হে
১৮. নমি নমি চরণে, নমি কলুষহরণে
১৯. পদপ্রান্তে রাখ সেবকে
২০. পেয়েছি অভয়পদ আর ভয় কারে
২১. প্রভু, তোমা লাগি আঁখি জাগে
২২. বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
২৩. ভয় হতে তব অভয় মাঝে
২৪. সকল কলুষ তামস হর, জয় হোক তব জয়
২৫. সার্থক করো সাধন
২৬. শীতল তব পদছায়া
২৭. হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে
২৮. হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই
২৯. হে মহাজীবন, হে মহামরণ লইনু শরণ
৩০. হে মহাজীবন হে মহামরণ
এই তালিকা সম্পূর্ণ নয়। মোটাদাগে বৌদ্ধদর্শন চিহ্নিত করা যায়, এমন ৩০টি গানের প্রথম কলি এখানে উল্লেখ করা হল। এর বাইরে অজস্র গান রয়েছে। বুদ্ধদর্শনকে রবীন্দ্রনাথ এমন গভীরভাবে আত্মস্থ করেছেন যে তাঁর সকল গানেই এর কোনো-না-কোনোভাবে প্রভাব রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যখন গেয়ে ওঠেন—
‘তুমি সুখ, তুমি শান্তি, তুমি হে অমৃত পাথার
তুমিই তো আনন্দলোক, জুড়াও প্রাণ, নাশো শোক,
তাপহরণ তোমার চরণ অসীম শরণ দীনজনার।
তখন বোঝা যায় যে, বুদ্ধতেই কবিগুরু আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। বুদ্ধের প্রতি কবির চরম নির্ভরতা প্রকাশ পেয়েছে এই গানে। ‘নমি নমি চরণে’ গানটিতে বুদ্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আনতি খুব তীব্র হয়ে ধরা দিয়েছে—
নমি নমি চরণে
নমি করুষহরণে॥
সুধারসনির্ঝর হে,
নমি নমি চরণে।
নমি চিরনির্ভর হে
মোহগহনতরণে॥
নমি চিরমঙ্গল হে
নমি চিরসম্বল হে
উদিল তপন গেল রাত্রি,
নমি নমি চরণে॥
গৌতমবুদ্ধ বাদে আর কোনো ধর্মবেত্তার পায়ের কাছে রবীন্দ্র নত হননি। বুদ্ধদেবই ছিলেন তাঁর কাছে একান্ত নমস্য। এই গানে সেই অভিব্যক্তিই প্রকাশ পেয়েছে তুমুলভাবে। ‘তোমা লাগি নাথ, জাগি, জাগি হে’, ‘এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ’, ‘সকল কলুষতামসহর, জয় হোক, তব জয় / অমৃতবারি সিঞ্চন করি নিখিলভুবনময়’ এ রকম বেশ কিছু গানেও বুদ্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের ভিত্তি প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের ও স্বদেশপর্বের গানে বুদ্ধচেতনার সন্ধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া নাটকের গানেও রয়েছে বুদ্ধচেতনার প্রকাশ। বিশেষ করে যে সকল নাটকে বৌদ্ধ আখ্যান রয়েছে, সে সকল নাটকের গানে সঙ্গতকারণেই বুদ্ধচেতনার প্রকাশ রয়েছে। ‘মালিনী’, ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ‘গুরু’, ‘অরূপরতন’, ‘নটীর পূজা’, ‘চণ্ডালিকা’ ও ‘শ্যামা—
এই নাটকগুলোতে ব্যবহৃত গানে বুদ্ধদর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। বলা যেতে পারে, বুদ্ধদর্শনকে চেতনায় ধারণ করেই এই নাটকের গানগুলো রচিত হয়েছে। ‘শ্যামা’ নাটকের কথাই ধরা যাক। বজ্রসেন যখন শ্যামাকে ক্ষমা করতে না পারার জন্য নিজের অক্ষমতাকে দায়ী করেন। আর তখন এই দীনতার জন্য গৌতম বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা জানান—
‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে
ক্ষম হে মম দীনতা পাপীজনশরণ প্রভু!
জানি গো তুমি ক্ষমিবে তারে
যে অভাগিনী পাপের ভারে
চরণে তব বিনতা
ক্ষমিবে না ক্ষমিবে না
আমার ক্ষমাহীনতা, পাপীজনশরণ প্রভু!
(শ্যামা)
নাটকে-কবিতায়-গানে খুব তীব্রভাবে বুদ্ধচেতনাকে গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাবিশ্বেও গৌতম বুদ্ধ ছিলেন সদাজাগ্রত। তাই ছোটগল্প ও উপন্যাসেও বুদ্ধপ্রসঙ্গ উঁকি দিয়েছে কখনও-কখনও। কিন্তু দুঃখের কথা, নিবেদনের কথা, ভক্তির কথা, ভালবাসার কথা, অনুরাগের কথা, প্রার্থনার কথা খুব তীব্রভাবে প্রকাশ করার জন্য সংগীতের চেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম আর নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বুদ্ধচেতনাকে প্রকাশ করতে গানকে অবলম্বন করছেন। বুদ্ধচেতনায় জারিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের গানও হয়ে উঠেছে সর্বাঙ্গসুন্দর!
লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক-ফোকলোরবিদ ও গবেষক। উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend