রবীন্দ্রনাথ ও আমরা

Rabindronath_1সঞ্জয় সরকার
“রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিষয়ে কিছু বলার জন্য আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। তাঁর পূর্ণরূপ নয়, বাঙালীর সাহিত্যে ও জীবনে তাঁর সামগ্রিক অবদান নয়— বিশেষভাবে তাঁর কবিতাই আমার আলোচ্য। আমি জানি এই কাজটিও সহজ নয়, কেননা সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েও তাঁর কবিতার পরিমাণ ও বৈচিত্র্য অতি বিপুল। যেমন সাহিত্যের স্রষ্টা হিসেবে, তেমনি শুধু কবি হিসেবেও তার বহুমুখিতা বিস্ময়কর; যেমন চিত্র রচনায় পিকাসো, তেমনি কাব্য রচনায় বিশ্বম্ভর আমাদের রবীন্দ্রনাথ।”
—এই অধম নয়, অতবড় মুরোদ এ অধমের সুনিশ্চিতভাবেই নেই যে, বিশেষত কবিতা তা আবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কবিতার আলোচনা নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হব। রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই আলোচনা নিয়ে এখন থেকে তেপান্ন বছর আগে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রোতামণ্ডলীর সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন, কবি, সম্পাদক, অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু। এটি বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত তাঁর একটি বক্তৃতার অংশ। পরবর্তীকালে এই বক্তৃতা তাঁর যে বইয়ে সংকলিত হয়েছে সেই বইয়ের নাম ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৬-এর জুনে; দে’জ পাবলিকেশন থেকে। বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন আর এক প্রখ্যাত কবি পূর্ণেন্দু পত্রী। বইটির আলোচনা আপাতত থাক। আমার লক্ষ্য রবীন্দ্রনাথের উপরে অতি সাম্প্রতিককালে রচিত অন্য একটি উপন্যাস। যার রচয়িতা সমসাময়িককালের বাংলাদেশের শক্তিমান লেখক হরিশংকর জলদাস। তাঁর এ উপন্যাসের নাম ‘আমি মৃণালিনী নই’। হরিশংকর জলদাসও সাহিত্যের অধ্যাপক। বাংলা সাহিত্যের।
‘আমি মৃণালিনী নই’-এর আলোচনায় যাবার আগে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে দু’-একটি কথা বলে নিই। রবীন্দ্রনাথ কেবল বাংলা কবিতার নন, বাংলা সাহিত্যের বিশ্বম্ভর। রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্যের নন, চিত্রকলারও ধ্রুপদী কর্মকার। বুদ্ধদেব বসুর উপরোক্ত উদ্ধৃতি রবীন্দ্র প্রতিভা উপলব্ধিতে বিশেষ সহায়ক হতে পারে— তাই অতি অপ্রচলিতও পুরোনো মূল্যায়নকে নবায়নের প্রয়াস।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অজস্র মূল্যায়নের পাশাপাশি তাকে অবমূল্যায়নেরও অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এ সব অপপ্রয়াসের অন্যতম একটি হল ‘নজরুল’কে তাঁর সমান্তরালে দাঁড় করানো।
এই বিবাদ ভঞ্জনের জন্য বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃত বক্তৃতার অন্য অংশে দৃকপাত করা যেতে পারে— ‘যা কিছু কবিতা নয়, তা থেকে কবিতাকে মুক্তি দিতে হবে’ ইয়েটসের এই সূত্রটি রবীন্দ্রনাথ কখনো শুনেছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু কবিতার শুদ্ধিসাধনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৮৯০ থেকে ১৯১০ এই দুই দশকের মধ্যে রচিত তাঁর অনেক কবিতা পাওয়া যাবে, যাতে নেই উপদেশ বা কাহিনী বা আলোচনা; যা রহস্যময় স্বজ্ঞাপ্রসূত, অর্ধালোকে উদ্ভাসিত ও প্রচ্ছন্ন নিত্য নবসংকেতের জন্মস্থল, এই কুড়ি বছরের মধ্যে ‘মানসী’ থেকে ‘গীতাঞ্জলী’ পর্যন্ত তাঁর কবি জীবনের একটি বৃত্তপূর্ণ হয়েছিল; তাঁর সবচেয়ে ঐশ্বর্যময় সৃষ্টি পর্ব এটি, সবচেয়ে ভাবঘন ও গভীর। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এই ‘গীতাঞ্জলী’র উপরে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, যখন ‘নজরুল’ মাত্র ১৩-১৪ বছরের বালক। তাঁরা দু’জন দুই প্রজন্মের কবি।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, তা তাঁর আপন রচনাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। এতেও অনেকের গায়ে জ্বালা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তাকে কী করার আছে? এই সব লেখার অধিকাংশইতো তার মৃত্যু পরবর্তীকালের।
রবীন্দ্রনাথকে খাটো করার অন্যতম একটি প্রচলিত প্রয়াস হল তিনি নকলনবীশ। গগণ হরকরা’র একটি গানের সুর নকল করে, তিনি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ (যেটি বর্তমানে আমাদের জাতীয় সংগীত) গানটিতে আরোপ করেছেন। স্কটল্যান্ডের কোন লোকসংগীতের সুর তিনি তাঁর অধিকাংশ সংগীতে প্রয়োগ করেছেন ইত্যাদি। এ সব কথার সহজ উত্তর— জগতের এত এত তত্ত্ব ও তথ্যের খবর যিনি রাখেন, তিনি কী প্রতিভাধর নন?
বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বজাতি বাঙালীর জন্য যে অমূল্য রত্মভাণ্ডার গচ্ছিত রেখে গেছেন, বাঙালী আজও তাঁর যথাযথ ব্যবহারের সামর্থ্য অর্জন করেছে বলে মনে হয় না। তেমন সামর্থ্য অর্জন করে থাকলে সামাজিক জীবনে এত অস্থিরতা, নৈতিকতার এত স্খলন হবার কথা নয়।
‘আমি মৃণালিনী নই’-এ আসা যাক। হরিশংকর জলদাস অসামান্য লেখক সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তাঁর ‘আমি মৃণালিনী নই’তে যে রবীন্দ্রনাথকে চিত্রিত করেছেন তা চরম হতাশাব্যঞ্জক। ‘উপন্যাস’ ইতিহাস নয়, এ কথা সত্য। কিন্তু উপন্যাসে তিনি যাঁকে অবলম্বন করেছেন তিনি তো রবীন্দ্রনাথই। তার উপন্যাস পড়ে যে কারও এই ধারণাই বদ্ধমূল হবে যে, রবীন্দ্রনাথ সবদোষে দুষ্ট কেবলই পরম স্বার্থপর এক মানুষ। পৃথিবীর তাবৎ দোষ যেন কেবল রবীন্দ্রনাথেরই। যা দৈব, তার দায়ও চাপিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ঘাড়েই। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম ভবতারিণী। এই নাম পাল্টে রবীন্দ্রনাথ নাম দেন মৃণালিনী। এতে নাম কেড়ে নেওয়ার নিষ্ঠুরতা যেমন থাকতে পারে, স্ত্রীকে ভালবেসে নতুন জন্ম দেওয়ার কাঙ্ক্ষা থাকাও অসম্ভব নয়, উপন্যাসটি পড়ে এই ধারণা জন্মায়, রবীন্দ্রনাথের পরিবার কেবলই আন্তঃপারিবারিক প্রণয় সম্পর্কের আখড়া। তার পরম স্নেহভাজন বিদূষী ভাইঝি ইন্দিরাও সুতীব্র, তীর্যক সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যায়নি। স্বল্পপরিসরে ব্যাপক আলোচনা সম্ভব নয়। না হলে বই থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেত। এতসব দেখে শুনে সেই বিখ্যাত প্রবচনটিই মনে পড়ে। ফলবান বৃক্ষেই ঢিল পড়ে, নিষ্ফলাবৃক্ষে নয়। রবীন্দ্রনাথ ক্রমাগত নিজের সৃষ্টি দিয়ে নিজেকেই উৎরেছেন বার বার, মানুষ রবীন্দ্রনাথও বোধ হয় তাই-ই।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend