জনতার রায় আজ

জনতার রায় আজদীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাজধানী ঢাকার দুই (ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ) সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আজ মঙ্গলবার। একই সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও। তিন সিটির নতুন মেয়র ও কাউন্সিলর বাছাই করতে সংশ্লিষ্ট ভোটাররা আজ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত একটানা চলবে এই ভোটগ্রহণ।

এবারের নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিন সিটিতে মেয়র পদে ৪৮ জন প্রার্থীসহ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে সব মিলিয়ে এক হাজার ১৮৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এ নির্বাচনে ৬০ লাখ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন।

সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটকেন্দ্র রক্ষা এবং ভোটারদের নিরাপত্তায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৮২ হাজার সদস্যকে মাঠে নামানো হয়েছে। ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণে নেমেছে ইসির ৪৫টি গোপন পর্যবেক্ষক টিম।

স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন নির্দলীয় হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধান দুই জোট দলগতভাবে প্রার্থী দিয়েছে। ফলে নির্দলীয় নির্বাচনে ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক উত্তাপ। এটি ‘হাইভোলটেজ নির্বাচনে’ রূপ নিয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে যেমন উত্সাহ-উদ্দীপনা রয়েছে, তেমনি ভোটারদের মধ্যে রয়েছে ভীতি ও সংশয়। মেয়র প্রার্থীরা সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, জয়-পরাজয় যাই হোক নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ফলাফল মেনে নেবেন। ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি জনগণ কখনো ভোট দিতে ভুল করে না। জয়-পরাজয়ের বিষয়টি জনগণের উপর ছেড়ে দিয়েছি।’

বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে নীরব ভোট বিপ্লব হবে। দক্ষিণের আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন বলেন, ‘এই নগরে আমার জন্ম-বেড়ে উঠা। আমার নিয়ত পরিষ্কার। আশা করি আমার পিতার মতো আমাকেও ভোটাররা বেছে নেবেন।’

তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস দাবি করেছেন, ভোট ডাকাতি না হলে মির্জা আব্বাস বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন।

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ. জ. ম. নাছির ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম সুষ্ঠু ভোট হলে ফলাফল যাই হোক মেনে নেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমির খসরু মাহমুদ অভিযোগ করেছেন, সরকার সমর্থকরা কারচুপি করার জন্য নগরের হোটেলে হোটেলে বহিরাগতদের জোগাড় করেছেন।

এদিকে, বিএনপি অভিযোগ করেছে, পুলিশ-র্যাব সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে নগ্নভাবে কাজ করছে। তাদের এজেন্টদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পুলিশ হানা দিচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে। দলটির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, অভিযোগ দেয়া বিএনপির একটি স্বভাব। নিশ্চিত পরাজয় জেনেই তারা কাল্পনিক অভিযোগ দিচ্ছে। দু’দলের এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার আশ্বাস দিয়েছেন। সিইসির দাবি নির্বাচনে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

মাঠে নেমেছে ৮২ হাজার ফোর্স

তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব মিলিয়ে ৮২ হাজার ফোর্স নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া ক্যান্টনমেন্টে তিন ব্যাটালিয়ন সেনাসদস্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা যখন চাইবেন, তখনই সেনাসদস্যরা চলে আসবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ। নির্বাচনী কাজ ছাড়া সকল প্রকারের যানবাহন চলাচলের ওপর আজ দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ভোটারদের নিরাপত্তা আর ভোটদান নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

তিন সিটির ২১৮০টি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের জন্য অতিরিক্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য রয়েছে। সাধারণ ভোটকেন্দে ২২ জন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দে ২৪ জন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। তিন সিটির প্রতি সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে পুলিশ, আনসার ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে একটি করে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। সেই সঙ্গে ভোটকেন্দ বিবেচনায় ১০০ প্লাটুন বিজিবি, ৭ প্লাটুন কোস্ট গার্ড ও র্যাবের ১০০টি টিম কাজ করছে। এদের সঙ্গে মাঠে নেমেছে পাঁচশ ম্যাজিস্ট্রেট। ২৬ এপ্রিল থেকে আগামী ২৯ এপ্রিল-এ চার দিনের জন্য তারা দায়িত্ব পালন করছে। নির্বাচনী পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে নির্বাচন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মনিটরিং সেল স্থাপন করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তরে ১৬ মেয়র প্রার্থী

ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে লড়ছেন ১৬ প্রার্থী। এদের মধ্যে ভোটের প্রচারণায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক (টেবিল ঘড়ি), বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল (বাস), বিকল্পধারার কেন্দ্রীয় নেতা মাহী বি চৌধুরী (ঈগল), জাপা সমর্থিত প্রার্থী বাহাউদ্দিন আহমেদ বাবুল (চরকা), সিপিবির আব্দুল্লাহ আল ক্কাফী রতন (হাতি), জাসদ সমর্থিত প্রার্থী নাদের চৌধুরী (ময়ূর), গণসংহতির মো. জোনায়েদ আব্দুর রহমান সাকিকেই (টেলিস্কোপ) সক্রিয় দেখা গেছে।

দক্ষিণে ২০ মেয়র প্রার্থী

ঢাকা দক্ষিণে ২০ জন মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাঈদ খোকন (ইলিশ মাছ), বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস (মগ), জাতীয় পার্টি সমর্থিত মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন মিলন (সোফা) ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মওলা রনিকে (আংটি) প্রচারণায় দেখা গেছে। ব্যালট পেপারে বিএনপির আসাদুজ্জামান রিপনের নাম থাকলেও তিনি কাজ করছেন মির্জা আব্বাসের পক্ষে। আর জাসদ প্রার্থী শহীদুল ইসলাম (বাস) সাঈদ খোকনকে সমর্থন দিয়েছেন।

চট্টগ্রামে মেয়র প্রার্থী ১২ জন

চট্টগ্রাম সিটিতে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১২ জন প্রার্থী। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আজম নাছির উদ্দিন (হাতি), বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনজুর আলম (কমলা লেবু), জাপার প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠ (ডিশ এন্টিনা) প্রচারণায় মাঠে সক্রিয় ছিলেন।

তিন সিটিতেই ৪৫ জন ইসির গোপন পর্যবেক্ষক
তিন সিটিতেই ভোটকেন্দ পাহারায় গোপন পর্যবেক্ষক হিসেবে ৪৫ কর্মকর্তাকে নিয়োগ করেছে ইসি। কমিশনের তথ্য মতে, দক্ষিণ সিটিতে ১৯ জন, উত্তরে ১২ জন এবং চসিক সিটিতে ১৪ জন কর্মকর্তা এ দায়িত্ব পালন করবেন। এ তালিকায় রয়েছে থানা নির্বাচন কর্মকর্তা থেকে জেলা ও সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। পর্যবেক্ষকরা ভোটকেন্দে নিয়োজিত ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা, ভোটার এবং প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করবেন। নির্বাচন চলাকালে কেন্দ্রের ভিতর কিংবা বাইরে কোন অসঙ্গতি দেখলে তাত্ক্ষণিক রিটার্নিং অফিসার এবং কমিশনকে জানাবেন তারা; সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ভোটে ব্যয় ৫০ কোটি ও ব্যালট পেপার পৌনে দুই কোটি

ইতোমধ্যে মেয়র, সাধারণ ও সংক্ষিত কাউন্সিলর পদে ভোটারের বিপরীতে তিনগুণ পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৮১ লাখ ব্যালট পেপার মুদ্রণ হয়েছে। তিন রঙের ব্যালট পেপার, ভোটকক্ষের সমপরিমাণ স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও অন্যান্য নির্বাচনী সামগ্রী সোমবার বিকালেই সব কেন্দ্রে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা পাহারায় পৌঁছানো হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনা ও আইন-শৃঙ্খলা মিলিয়ে এবার ভোটে খরচ হবে ৫৫ কোটি টাকা।

সাংবাদিক ও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক

এ নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক মিলে ১১ হাজারের বেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন। এদের মধ্যে বিদেশি পর্যবেক্ষণ সংস্থা, বিভিন্ন দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম, দেশীয় পর্যবেক্ষণ সংস্থা ও দেশীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণ রয়েছেন। অন্য যেকোন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়ে এবারই রেকর্ড সংখ্যক পর্যবেক্ষক এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন বলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জনসংযোগ শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত হাজার স্থানীয় সাংবাদিকের নামে কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক রয়েছেন। এদিকে কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থার অনুমোদন নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। সিইসির কাছে অভিযোগে তারা বলেছেন, সিটি নির্বাচনে ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে; যার মধ্যে ৪/৫টি ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার এখিতয়ার, দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

তিন স্থানে ফলাফল কেন্দ্র

নির্বাচন কমিশন ঢাকা উত্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে, ঢাকা দক্ষিণের জন্য মহানগর নাট্যমঞ্চে এবং চট্টগ্রামের জন্য জিমনেসিয়ামে ফলাফল ঘোষণার কেন্দ্র স্থাপন করেছে। ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসাররা তাদের ফলাফল বিবরণীসহ এসব কেন্দ্রে জমা দেবেন।

ভোটকেন্দ্র, কক্ষ ও ভোটার

তিন সিটিতে মোট ভোটকেন্দ্র ২ হাজার ৭০১টি, ভোটকক্ষ ১৫ হাজার ৫৪৪টি, মোট ভোটার ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৬ জন। ঢাকা উত্তরে ওয়ার্ড ৩৬টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১২টি, ভোটকেন্দ্র ১০৯৩টি, ভোটকক্ষ ৫৮৯২টি, ভোটার ২৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন। ঢাকা দক্ষিণে ওয়ার্ড ৫৭টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৯টি, ভোটকেন্দ্র ৮৮৯টি, ভোটকক্ষ ৪৭৪৬টি, ভোটার ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৩ জন এবং চট্টগ্রামে ওয়ার্ড ৪১টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৪টি, ভোটকেন্দ্র ৭১৯টি, ভোটকক্ষ ৪৯০৬টি, ভোটার ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৯ জন।

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend