কাঁটাতারের বেড়ায় লাখো মানুষের মিলন

Panchagaধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও ভৌগলিক সীমারেখার বেড়াজাল; আছে কাঁটাতারের বেড়াও। কিন্তু কোনো বাঁধাই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের লাখো বাঙ্গালি মায়া-মমতা আর ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে মিশে যেন একাকার হয়ে যান।
কাঁটাতারের বেড়া উপেক্ষা করে দুই বাংলার মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাস আর আবেগে মিলিত হতে পারাই এ মিলনমেলার মূল লক্ষ্য। মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে জেলার সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের ৭৪৩ ও ৭৪৪ নম্বর মেইন পিলারের মাঝের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় দুই দেশের নাগরিকদের মিলনমেলা। বিকেল ৪টা পর্যন্ত এটি চলে।
১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির আগে পঞ্চগড় জেলার সদর, তেঁতুলিয়া, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলা ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অধীনে ছিল। পাক-ভারত বিভক্তির পর এসব এলাকা বাংলাদেশের অর্ন্তভুক্ত হয়। দেশ বিভক্তির কারণে উভয় দেশের নাগরিকদের আত্মীয়-স্বজন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুই দেশের নাগরিকরা বিনা বাঁধাই আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া-আসার সুযোগ পান। কিন্তু ভারত সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের পর অবাধ যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। পাসপোর্ট করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভারত বা বাংলাদেশে যাতায়াত করে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উভয় দেশের নাগরিকদের অনুরোধে নববর্ষের প্রথম দিন বিজিবি ও বিএসএফের সহযোগিতায় অমরখানা সীমান্তে দুই বাংলার এ মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দুই বাংলার মানুষ বিশেষ এ দিনে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান। সারা বছর তারা এ দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন।

প্রতি বছর বৈশাখ মাসের এ দিনে দুই দেশে বসবাসকারী লাখো মানুষ বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ী, চাচা-চাচী, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের সান্নিধ্য লাভ করেন। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভাব বিনিময় করেন। অমরখানা সীমান্তের কাঁটাতারের দুই পাড়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভাব বিনিময় ও মিলনের জন্য এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ান। দীর্ঘ এক বছর বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা দুই বাংলার মানুষের মিলনের এ মেলায় অন্যরকম এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আনন্দে কান্নায় ভেঙে পড়া, কথোপকথন আর খোশগল্পে মেতে ওঠেন লাখো মানুষ। স্বজন ও পরিচিতদের দেখে অনেকে আবার আবেগে কেঁদে ফেলেন। এ কান্না বিরহের নয়, মধুর মিলনের।
দুই দেশের লাখো নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধ সকাল থেকে জড়ো হতে থাকেন সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি-বিএসএফ সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়। সকাল ১১টায় বিএসএফ-বিজিবি সদস্যরা একমত হয়ে কাঁটাতারের বেড়ার কাছ যাওয়ার অনুমতি দিলে বাঁধভাঙা ঢল নামে। নোম্যান্সল্যান্ডে প্রবেশ করেন লাখো মানুষ।

বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়ার গেট থেকে তাদের সীমান্ত রেখায় এসে অবস্থান নেন। বিজিবিও একই স্থানে এসে নিজদের মধ্যে কুশল বিনিময় করেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কাঁটাতারের বেড়ার দুই পাড়ে বাংলাদেশ ও ভারতের লক্ষাধিক মানুষ তাদের স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। কাঁটাতারের ওপর দিয়ে বিস্কুট, চানাচুর আর সিগারেটের প্যাকেট ছুড়ে দিচ্ছেন একে-অপরকে। কেউবা আত্মীয়-স্বজনদের দেওয়ার জন্য ঠাণ্ডা পানীয় বোতলও ছুড়ে মারছেন। কেউ কেউ বেড়ার এপাড়-ওপাড়ে হাত নাড়িয়ে বা উচ্চ স্বরে কথা বলে স্বজনদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। কেউবা আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া, হাত দিয়ে কেউ কাউকে স্পর্শ করতে না পারলেও হৃদয়ের স্পর্শ ছুঁয়ে যায় সবার মাঝে।
জলপাইগুড়ি জেলা শহরের আসির উদ্দিনের (৬৫) সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী এলাকার মসলিমা খাতুন। দীর্ঘ এক বছর পর নববর্ষ উপলক্ষে ভাই-ভাবীদের সঙ্গে দেখা করেছেন। দেখা করতে পেরে তিনি খুব খুশি। জানান, এ দিনের জন্য দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে।

ঠাকুরগাঁও শহরের মেরিনা বেগম ভারতের কোচবিহারে বসবাসরত খালাত ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। দেখাও করেছেন। কিন্তু এভাবে দেখা করতে তাদের কষ্ট হয়। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা করে শান্তি পান না। কোনো একটি স্থানে ভালভাবে দেখা করার সুযোগ
করে দেবে উভয় দেশের সরকার- এমন দাবি তার।
জেলার বোদা উপজেলা শহরের সুলতানা বেগম ভারতের শিলিগুড়িতে থাকা ভাইদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ভাইদের জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন। পোলাও-মাংস, ইলিশ মাছ সবই এনেছেন, দিয়েছেনও। দেখা করে জিনিসগুলো দিতে পেরে খুবই আনন্দিত তিনি।
জেলা শহরের ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার কলেজিয়েট ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সেকেন্দার আলী জলপাইগুড়িতে থাকা বোনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। দেখা পেয়ে বেজায় খুশি তিনি। পয়লা বৈশাখের এ দিনের জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন। কাঁটাতারের বাইরে বাংলাদেশের ভেতরে বা ভারতের ভেতরে গিয়ে আরও কাছাকাছি হয়ে দেখা করার
সুযোগ দিতে তিনি উভয় দেশের সরকারের কাছে অনুরোধ জানান।
জেলা শহরের ইসলামবাগ এলাকার রিফাত সামস রায়হান হৃদি বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকদের মিলনমেলার কথা শুনে সীমান্তে এসেছেন দেখতে। বলেন, ‘এক সঙ্গে এত মানুষের মিলিত হওয়ার দৃশ্য জীবনেও দেখিনি। খুব ভাল লাগছে।’
অমরখানা এলাকার বৃন্দ জহিরউদ্দিন (৭০) বলের, ‘গরিব মানুষ বাবারে, ভারতে গিয়ে ভাই-বোনদের দেখা করার উপায় নাই। পাসপোর্ট-ভিসাও করিবা পারি না। পয়লা বৈশাখে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করি। দূর থেকে দেখে মনটার শান্তি হয়।’
বিজিবি ও বিএসএফের সম্মতিতে উভয় দেশের মানুষের এ মিলনমেলায় শুধু পঞ্চগড় জেলার নাগরিকরাই নয়, পাশের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার জেলার লাখো মানুষ অংশ নেন।
ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) খালাপাড়া ক্যাম্প ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অমরখানা ক্যাম্পের সদস্যরা এ মিলনমেলায় উভয় পাশের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন।
পঞ্চগড় ১৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ আরিফুল হক বলেন, প্রতিবছর এখানে উভয় দেশের নাগরিকদের মিলনমেলা হয়ে থাকে। দুই দেশের নাগরিকরা যাতে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান, এ জন্য আমরা বিএসএফের সঙ্গে আলোচনা করে এ মেলার আয়োজন করেছি।
তিনি বলেন, দিনটি উভয় দেশের নাগরিকদের জন্য বিরাট পাওনা। মিলনমেলাটি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend