পলিসিস্টিক ওভারি : বন্ধ্যত্বই নয়, হতে পারে ক্যান্সার

polycystic2অনিয়মিত মাসিক নিয়ে নারীদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। অনিয়মিত মাসিক ও বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ পলিসিস্টিক ওভারি। আজকাল নারীদের প্রায়শই পলিসিস্টিক ওভারি নিয়ে অভিযোগ করতে শোনা যায়। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম শরীরকে কাবু করে দেয়। ইনসুলিন রেজিসটেন্সের জন্য ডায়াবেটিস ঘাঁটি গাড়ে। বাড়তি ওজন বা ওবেসিটি ডেকে আনে উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে হার্টের অসুখও। ঝুঁকি রয়েছে আরও, যেমন বছরে তিনবারের কম মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল হলে এন্ডোমেট্রিয়াম পুরু হয়ে যেতে পারে, যা অনেকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্লিডিং করা এবং এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়ায়।
কয়েকজন রোগীর কথা
১. ঢাকার গুলশানের হাসিনা বেগম গৃহবধূ, বয়স ৩৮।

দশ বছর আগে একমাত্র কন্যাসন্তান জন্মদানের পর ইউটেরাসে টিউমার ধরা পড়ে। অপারেশনও করান। সবই ঠিক চলছিল কিন্তু বছর ১৫ বছরের মেয়ে সাকিনার তিন মাস হলো পিরিয়ড অনিয়মিত। বেশ মুটিয়েও যাচ্ছে। মুখে ব্রণ, হাতে পায়ে অস্বাভাবিক লোম গজাচ্ছে। লক্ষণ ভালো না বুঝেই মেয়েকে নিয়ে যান দক্ষিণ কলকাতার শরৎ বোস রোডের পার্কল্যান্ড চেম্বারে, নিজের গাইনোকলজিস্টের কাছে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করতেই ধরা পড়ল পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনসড্রোম। যদিও এখনো পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বংশগত এমন প্রমাণ নেই, তবুও সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী।
২. চট্রগ্রামের আফরোজা বেগম ছেলের বিয়ে দিয়েছেন দু’বছর। বৌমা বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করেন। অথচ এখনো সন্তানহীন। বিপদ আঁচ করেই বৌমাকে নিয়ে ছুটলেন পরিচিত সুপ্রজনন বিশেষজ্ঞের কাছে। পরীক্ষা করতেই ধরা পড়ল ওভ্যুলেশন বন্ধ। ছ’মাস চিকিৎসা চললেও ফল মিলল না। অতঃপর ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতিতে ওভারিয়ান ড্রিল করে ওভ্যুলেশন চালু করা হলো। বৌমা কনসিভ করেছে, বৌমার কোলজুড়ে আলো করে সন্তান আসবে সেই ভাবনাতেই হাসি ফুটেছে আফরোজা বেগমের মুখেও।
৩. সিলেটের সুনামগঞ্জের ফরিদা বিবি, পেশায় নামী স্কুলশিক্ষিকা, বয়স ৪৩। দু’সন্তানের জননী। বেশ কিছু দিন ধরেই মেনস্ট্রুয়েশন অনিয়মিত। মোটাও হয়ে যাচ্ছিলেন, সঙ্গে ধরা পড়ল ডায়াবেটিস। পারিবারিক চিকিৎসকের কাছে যেতেই পরামর্শ দিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখাতে। চলে এলেন কলকাতার পার্কল্যান্ড চেম্বারে। হিস্টোরোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষার পর জানা গেল যে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। তিনিও বেশ কিছুদিন ধরেই ভুগছিলেন পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে।
শুধু এই তিনজনই নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এখন পলিসিস্টিক ওভারিজনিত সমস্যা বড় আকার নিয়েছে। ফলে শুধু বন্ধ্যত্বই নয় তন্দ্রার মতো হতে পারে ক্যান্সারও। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম একজন নারীর জীবনে নানা বিপর্যয় ডেকে আনে। এর থেকে মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল এলোমেলো হয়ে যায়। হরমোন উৎপাদনের ভারসাম্যও নষ্ট হয়। সবার উপরে নারীর লাবণ্য ও রূপে বিশাল ঘাটতি দেখা দেয়, যা অন্য অর্থে নারীর মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে।
চিনবেন কিভাবে?
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের বেশ কিছু চেনা লক্ষণ রয়েছে। প্রথমেই বলতে হয় মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল অনিয়মিত বা একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, অনেক চেষ্টার পরেও প্রেগনেন্সিতে সাফল্য অধরা থেকে যায়, সারা গায়ে মুখে অস্বাভাবিক চুল বা লোম বৃদ্ধি পায়, মাথার চুল পাতলা হতে থাকে, বহু চেষ্টা করেও দেহের ওজন বৃদ্ধি আটকানো যায় না, হঠাৎ মুড স্যুইং, মানসিক অবসাদ যেন মনকে গ্রাস করে। এর ফলে অবসন্ন ভাব, ঝিমুনি লাগা, এমনকি দিনের বেলাও নাক ডাকতে পারে। অনেকের হয়ত এ সব লক্ষণ একসঙ্গে ধরা পড়ে না, কিন্তু এর মধ্য থেকে কিছু লক্ষণ যদি মিলে যায় বা কিছু শারীরিক উপসর্গ যদি কমন হয়, তাহলে সাবধান। হতে পারে আপনিও পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের পথে এগোচ্ছেন।
কারণ
অস্বাভাবিক হরমোন লেভেলের জন্যই সাধারণত পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম দেখা দেয়। এমনিতে এ সমস্যার কোন সঠিক কারণ বের করা যায় না। তবে দেখা গেছে পরিবারে আগে যদি কেই এই সমস্যায় ভুগে থাকেন তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই মা, দিদিমা বা কোনো নিকট আত্মীয়ের যদি এ সমস্যা হয়ে থাকে সাবধান হোন। দেখা গেছে, যারা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে ভোগেন তাদের ওভারি থেকে মাত্রাতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ হয়, তাই মনে করা হয় যে যাদের শরীরে বাড়তি টেস্টোস্টেরন থাকে তাদের মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের উপসর্গ প্রকটভাবে দেখা দেয়।
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম হলে শরীরে ইনসুলিন রেজিসটেন্স দেখা দেয়। ফলে ইনসুলিন ক্ষরণ হলেও শরীর তেমনভাবে সাড়া দেয় না। তাই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়ে। বেড়ে যাওয়া গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখতে দেহে আরও বাড়তি ইনসুলিন ক্ষরণ হয়। ফলে বাড়তে থাকে ওজন। মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল অনিয়মিত হয়, বাড়তে থাকে টেস্টোস্টেরনও।
ডায়াগনোসিস
পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম হয়েছে কিনা বোঝার জন্য রক্ত পরীক্ষাই যথেষ্ট। রক্ত পরীক্ষা করলে দেহে বাড়তি মাত্রায় টেস্টোস্টেরনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান করলে পলিসিস্টিক ওভারি ধরা পড়ে।
বাঁচার উপায়
সমস্যা জটিল হওয়ার আগে চিকিৎসার দরকার। এখন জরায়ুর ভিতরের দেওয়াল রক্ষার জন্য অনেক উপায় বেরিয়েছে। প্রজেস্টোজেন হরমোন ১০ দিনের কোর্স গ্রহণ করলে অথবা একটানা কন্ট্রাসেপটিভ পিল বা ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইজ মিরেনা প্রয়োগ করেও এ সমস্যার মোকাবিলা করা হচ্ছে। হতাশ হবেন না চেষ্টা করলে আপনিও এর থেকে রেহাই পেতে পারেন। চেষ্টা করুন সুষম আহার নিতে। চিনি, নুন, কফি এবং এ্যালকোহল বন্ধ করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন নিয়ম করে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। মনে রাখবেন পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। লাইফস্টাইল নিয়ন্ত্রণে থাকলে উপসর্গও বশে থাকে।
ডা. শাহজাদা সেলিম
এমবিবিএস, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম)
এমএসিই (ইউএসএ)
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend