বিশ্ব খাদ্য দিবস আজ; শিশুর কষ্টের আয়ে ভাতের জোগান

pic-08_139946 (1)সাকিব ও মাকসুদা ভাই-বোন। সংসারে বাবার সঙ্গে ভাতের জোগান দিতে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধানের ছড়া কুড়ায়। ধান মৌসুমে প্রতিদিন দুজনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি ধান কুড়িয়ে ঘরে ফেরে। আমন মৌসুমে সকাল থেকে ইঁদুরের গর্তের সন্ধানে বের হয় তারা। কাস্তে দিয়ে গর্ত খুঁড়ে সংগ্রহ করে ধান। এভাবে চলে প্রায় দুই থেকে আড়াই মাস। এ জন্য প্রতিদিন প্রায় আট থেকে ১০টি ইঁদুরের গর্ত খুঁড়তে হয় তাদের। মাকসুদা বলে, ‘আমরা গরিব। বাবায় একলা কামাই কইরগ্যা সামলাইতে পারে না। প্যাড ভইরগা ভাত খাওনের লইগ্যা ছড়া টহাই, ডাইল টহাই, মাছ দরি।’

সাকিব ও মাকসুদার বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের মমিনপুর চরে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে তেঁতুলিয়া নদীতে জেগে ওঠা চরই মমিনপুর নামে পরিচিত। বাবা দুলাল গাজী ও মা নাসিমা বেগম। ধান মৌসুম এলেই সন্তানদের ইঁদুরের গর্ত খুঁড়তে তাড়া করেন অভিভাবকরা। পরিবারের অভাব দূর করতে মৌসুম পরির্বতনে এই ভাই-বোনের পেশার পরির্বতন হয়। ধানের ছড়া কুড়ানো শেষ হলে শুরু হয় লাকড়ি কুড়ানি। বর্ষায় শিকার করে মাছ। শিশু হলেও বছরজুড়ে থাকে কাজের তাগিদ। বাবা দুলাল গাজী বলেন, ‘গুরাগ্যারারে কামাই করতে না পাডাইয়া উপায় কী। একজনের কামাইয়ে খাওন পড়ন সব তো অয় না। আমাগো মোতো গরিব মাইনষ্যের গুরাগ্যারার কামাই না অইলে সংসার চলে না।’ ভিজিএফ, ভিজিডি কিংবা সরকারি কোনো সাহায্য পান কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমারে কোনো সাহায্য কেউ দেয় না।’ স্থানীয় মমিনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা দুই ভাই-বোন পরিবারের জন্য আয় করার ধান্দার কারণে স্কুলে হাজির হতে পারে না নিয়মিত। তাই লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত তাদের। এ ব্যাপারে মাকসুদা বলে, ‘স্কুলে গেলে ছুটি অওনের লগে লগে কামে নামি। নালে খামু কী।’ শুধু দুলাল গাজীর সন্তানরাই অভাবের কারণে ইঁদুরের গর্ত খোঁড়ে না। এ সময় দুলাল গাজীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কবির ব্যাপারীও জানান, তাঁর দুই ছোট ছেলে আরিফ ও সুজন সংসারে খাদ্যের জোগান দিতে কাজ করে। তিনি বলেন, ‘ভাই এলাকায় গরিব বেশি, আমাগো এলাকার সবাইর গুরাগ্যারা সংসারের লইগ্যা কামাই করে। পোলাপানের কামাই ছাড়া আমাগো মোতো গরিবের সংসার চলে না।’

মমিনপুর চর থেকে ট্রলারযোগে ৩০ মিনিট তেঁতুলিয়া নদী পাড়ি দিয়ে চর রায়সাহেব, চর ব্যারেট, চর মিয়াজান, চর ওয়াডেল, চর দিয়ারাকচুয়া ও চর নিমদি তেঁতুলিয়ার বুকে। এসব চরে মানববসতি গড়ে ওঠেছে আরো ৪০ থেকে ৫০ বছর আগে। বিভিন্ন এলাকার নদীভাঙা অভাবী ও অসহায় মানুষরা আস্তানা গেড়েছে এসব চরে। বছরের পর বছর গেলেও অভাবী ওইসব মানুষ প্রভাবশালীদের দাপটে খাসজমি পায় না। অন্যদিকে এক বছরের জন্য খাসজমির ডিসিআর নিয়ে আবাদ করলেও রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা-কর্মীরা লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে সেই পাকা ধান কেটে নিয়ে যায়। ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত বিচ্ছিন্ন ওইসব চরের মানুষগুলো বাঁচার তাগিদে পরিবারের ছোট-বড় সবাইকে নিয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে। ৬৫ বছর বয়সের চরব্যারেটের বৃদ্ধ আমির আলী প্যাদ্যা বলেন, ‘আমাগোরে সরকার কোনো সাহায্য দেয় না। জায়গাজমিও দেয় না। ধানপান লাগাইলে নেতারা জোড়জুলুম কইরগ্যা কাইট্টা লইয়া যায়।’

এ সব চরে অসংখ্য শিশু শ্রমিক। তাদেরই দুজন হলো হাসি ও খুশি। চর রায়সাহেবের হাশেম গাজীর মেয়ে হাসি এবং আজাহার প্যাদার মেয়ে খুশি। হাসি সাত বছরের, খুশির বয়সও প্রায় কাছাকাছি। পরশি বলে ওরা দুজন খেলার সাথি। সকালের সূর্যোদয় ও বিকেলের সূর্যাস্ত অবধি এক সঙ্গে পার করে দুজন। পুতুলখেলার বয়স না কাটলেও ওদের খেলতে হচ্ছে জীবনখেলা। মা-বাবার সংসারে পরিবারের বয়স্কদের মতো ওদেরও সাধ্যমতো আয় করতে হয়। কোমলমতি ওই দুই শিশু পরিবারের সহযোগী আয়ের সদস্য। দুই মুঠো ভাতের জোগান দেওয়ার তাগিদে হাসি ও খুশি পুতুল খেলার সময় পায় না। আর লেখাপড়া ওদের কাছে বিলাসিতা। সারাক্ষণ আয়-রোজগারে ব্যস্ত থাকে দুজন। আউশ ধানের মৌসুম শেষ হয়ে গেছে সম্প্রতি। ওই সময় হাসি ও খুশি হাঁটু জলে ধানের ছড়া কুঁড়িয়েছে সংসারের আয় বাড়াতে। হাসি বলে, ‘কাম করি দেইক্যা মা-বাপে ভাত দেয়, নালে ঘরের তোন নামাইয়া দেতে। এ্যাহন কামাই কম। পোউশ মাসে ইঁন্দুরের অদে ধান বেশি পাওন যায়।’ খুশি বলে, ‘স্যালোয়ার-কামিজ কিন্যা দেওয়ার টাহা দেতে পারে না বাবায়, ছড়া টহাইন্না ধান বেইচ্চা জামা-কাপুড় কিনমু।’ হাসির বাবা হাশেম গাজী বলেন, ‘আমাগো জমি নাই, কাম কইর‌্যা খাইতে অয়, চত্রির মাসের রৌদ যেই বিলে খাঁ খাঁ করে, আমাগো প্যাডেও ওই রোহম খুদা। হেই লইগ্যা ঘরের হগোলডি মিল্লা কাম না করলে দিনের খাওন চলে না।’

ওই উপজেলার মানববসতি গড়া ১৬টি চরে প্রায় ২৫ হাজার শিশু। এসব শিশুদের বেশির ভাগই পরিবারের সহযোগী আয়ের সদস্য হিসেবে কাজ করে সংসারে খাদ্যের জোগান দেয়। তাদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করলেও কাজ করার তাগিদে ওদের স্কুলে যাওয়া হয় না নিয়মিত। এসব কারণে দুই থেকে চার ক্লাস লেখাপড়ার পর শিক্ষা বিমুখ হয়ে পড়ে এসব শিশুরা। চর মিয়াজানের শাহ আলম পণ্ডিত বলেন, ‘চরের পোলাপান চাইর-পাঁচ বচ্ছর বয়স অইলেই কাম শুরু করে। যে যেই বিলে পারে দুউগ্যা চাউল-ডাইলের ব্যবস্থা করে।’ এ ব্যাপারে জেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা শাহিদা বেগম বলেন, ‘শিশুশ্রম বন্ধ করে সব শিশুর লেখাপড়া নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরে পটুয়াখালীতে ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় অ্যানাবেলিং ইনভায়রনমেন্ট ফর চাইল্ড রাইস (ইইসিআর) নামের একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend